৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ১১:১৪

পাঠ্যপুস্তকে ধর্মবিশেষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং মুসলিমদেরকে হেয় করা হয়েছে

-আসিফ আরসালান

আজ একাধিক বিষয় নিয়ে লিখবো। কারণ এরমধ্যেই কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে যেগুলো বিদ্যমান রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আন্দোলনকারীদের চোখে ততখানি গুরুত্বপূর্ণ না হলেও জাতির ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরমধ্যে একটি হলো স্কুল লেভেলে পাঠ্য বইয়ে ইসলাম ধর্ম বিরোধী বিষয়সহ আরো অনেক অপ্রয়োজনীয় ও ভুল তথ্য সম্বলিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি।

আরেকটি হলো মহাপবিত্র জমজমের পানি নিয়ে এক ধরনের ব্যবসায়ীর নামে কিছু অমানুষের ব্যবসা নামের অমার্জনীয় অপরাধ। আরেকটি হলো ‘আদর্শ প্রকাশনী’ নামক একটি পুস্তক প্রকাশনীকে বই মেলায় স্টল বরাদ্দ না দিয়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃক মতামত প্রকাশের কণ্ঠরোধ। প্রথমেই আসছি পাঠ্য পুস্তকে মুসলিম বিরোধী এবং অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় কিন্তু মতলবী বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি।
আমি আরো দুই এক সপ্তাহ আগে থেকেই পাঠ্য পুস্তকের ওপর লিখতে চেয়েছিলাম। এ ব্যাপারে দুই তিনটি দৈনিক এবং সাপ্তাহিক কিছু কিছু ইতোমধ্যেই লিখেছে। আমি সেগুলো পড়েছি। কিন্তু অভিযোগগুলোর প্রামাণিক দলিল আমার হাতে না আসায় সেগুলো লিখতে পারিনি। কয়েকটি পত্রিকায় যা কিছু লেখা হয়েছে তারচেয়েও গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু সেখানেও ঐ একই কথা। যেহেতু আমার হাতে বইগুলো আসেনি তাই লিখিনি। ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনি বলেছেন যে, না জেনে না শুনে বা না পড়ে আপনারা কেউ কিছু লিখবেন না। এরমধ্যে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল একটি ভিডিও আপলোড করেছেন ইউটিউবে। সেটি ডাউনলোড করে পুরোটা আমি শুনলাম। ঠিক করলাম, আসিফ নজরুলের মত বিদগ্ধ ব্যক্তি যখন ঐসব অভিযোগের অংশবিশেষ নিজেই শেয়ার করছেন তখন ঐসব অভিযোগের কতগুলো বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। আমি তাই আসিফ নজরুলের বক্তব্য হুবহু আপনাদের সামনে পেশ করছি। তিনি বলছেন,

“ক্লাস সেভেনের সমাজ বিজ্ঞান এবং ইতিহাস বইতে যা লেখা হয়েছে সেটি আরো অনেক বেশি গর্হিত অপরাধ হয়েছে। ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। মুসলিম প্রশাসক বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে অসংখ্য ছবি দেওয়া হয়েছে একটি বিশেষ ধর্মের, বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনার ছবি দেওয়া হয়েছে। মসজিদের কোনো ছবি নাই। মাত্র তিনটি ছবি আছে। আপনি একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাত দেখাবেন আর অন্য ধর্মের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবেন এটা এ্যাক্সেপ্টেবল না। সেভেনের সমাজ বিজ্ঞান এবং ইতিহাস বইতে যা লেখা হয়েছে সেখানে আরো অনেক গর্হিত অপরাধ হয়েছে। ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। যথাযোগ্য রেফারেন্স না দিয়ে যা ইচ্ছা তাই লেখা হয়েছে। এখানে ম্যাসেজ দেওয়া হয়েছে দুইটা। প্রথমটা হলো ব্রিটিশ পূর্ব যে মুসলিম শাসকরা ছিল তারা ছিল ভিনদেশী, তারা ছিল অত্যাচারী, বৈষম্যকারী ইত্যাদি। তাদের আগে যারা বাংলাদেশের শাসক ছিলেন অর্থাৎ যারা হিন্দু ধর্মের বা বৌদ্ধ ধর্মের ছিলেন তাদের আমলে সুখের নহর বয়েছিল বেশি, তাদের আমলে কোনো সমস্যা ছিল না। এটার মাধ্যমে তো আসলে ইসলাম ধর্মের প্রতি এবং ইসলামের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে। এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। ক্লাস সেভেনের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে এসব ধারণার সৃষ্টি করা হয়েছে। আসলে এটিই হলো সাম্প্রদায়িকতা।”

আপনার এ্যাপ্রোচের ক্ষেত্রে প্রবলেম আছে। আপনি যদি সামাজিক বিজ্ঞান বা ইতিহাস বই আনবেন তখন কন্টেন্টের (বিষয়সূচী) মধ্যে ধর্মীয় বিষয় প্রাধান্য পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেখানে ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এখানে অসংখ্য ছবি দেওয়া হয়েছে একটা বিশেষ ধর্মের। একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনাস্থলের ছবি দেওয়া হয়েছে। মুসলমানদের প্রার্থনাস্থলের ছবি নাই। আছে মাত্র তিনটা। আমি এটার ওপর আলোচনা টালোচনা করে বুঝলাম সেখানে আপনি একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাত দেখাবেন আর ইসলাম ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করবেন এটা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশে যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী আছেন তাদের ধর্মানুভুতিতে আঘাত করার জন্য চেষ্টাই শুধু নয়, ইতিহাস বিকৃত করারও চেষ্টা। সবচেয়ে বড় কথা, আপনি যদি সাউন্ড আর্গুমেন্ট তৈরী করতে পারতেন, রেফারেন্স দিতে পারতেন, কমপ্যারেটিভ এ্যানালাইসিস দিতে পারতেন- পাল আমলে এই রকম ছিল, সেন আমলে এই রকম ছিল, সুলতানী আমলে এই রকম ছিল, সেখানে যদি দেখা যেত যে প্রত্যেকটি ঘটনা হিস্টোরিক্যালি ট্রু, কমপ্যারেটিভলি এ্যানালাইসিস করে যদি দেখা যেত যে সেখানে অবজেক্টিভিটি আছে তাহলে সেটি গ্রহণযোগ্য হতো।

আপনি অন্য কারো সমালোচনা করলেন না, শুধুমাত্র ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির কথা বললেন। সে নাকি অনেক বিহার ধ্বংস করেছে। কোনো ঐতিহাসিকের বিবরণীতে এসব কথা নাই। এখানে কী বলবো আমি, খুব দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো এই যে, অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে করা হয়েছে মুসলিম সমাজ সম্প্রদায়কে হেয় করা। আপনি যখন কন্টেন্ট দিলেন তখন আপনি নিজের মতামত, রাজনৈতিক বিশ^াস বা ধর্মীয় বিশ^াস দিতে পারেন না। পাঠ্য পুস্তক আপনার প্রোপার্টি নয়, রাষ্ট্রের প্রোপার্টি। রাষ্ট্র যখন কোনো বিষয়ে পাঠ্য পুস্তক তৈরী করবে তখন নৈর্ব্যক্তিকভাবে লিখবে এবং যুক্তি তথ্য নির্ভরভাবে লিখবে এবং যথাসম্ভব ছাত্রদেরকে সৃজনশীল করার চেষ্টা করবে। অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টি করবে, কোনো রকম ঘৃণা বা বিরাগ সৃষ্টি করবে না। ফান্ডামেন্টাল পারপাসটা এখানে অনেকখানি লঙ্ঘিত হয়েছে। এছাড়া আপনি আরো দেখবেন যে, পাঠ্য পুস্তক রচয়িতারা অনেক জায়গায় অনেক নাম দিয়েছেন। অনেক বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকও আছেন। এই পাঠ্য পুস্তক যাদের প্রণয়ন করার কথা সেই মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকরা কোথায়? আমরা তো স্কুল কলেজে পড়েছি, সেখানে অসংখ্য ভাল শিক্ষক ছিলেন। তাদের ইনভলবমেন্ট কোথায়? ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের যে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আছে, কনসার্নড (সংশ্লিষ্ট) বিষয়ের যে এক্সপার্টরা আছেন ওনারা কোথায়? দেখা গেছে যে, এই ধরনের বিষয়ে যাদের বড় ধরনের কোনো কাজ নাই তাদেরকে ইনভলব করা হয়েছে। এখানে প্রশ্ন আসে যে যখন মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্য পুস্তক রচিত হয় তখন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, যাদের কনসার্নড বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নাই, অথবা একটি ন্যাশনাল বা ইন্টারন্যাশনাল পর্যায়ে যার এ্যাক্সেপ্টিবিলিটি (গ্রহণযোগ্যতা) নাই তাকে আপনি রাখছেন কিভাবে? এ ছাড়া সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে কিনা।

একটি বিষয় লক্ষ্য করার আছে। সেটি হলো এই যে, যখন একটা ভুল বের হয় তখন বলা হয় যে তড়িঘড়ি করে এটি করা হয়েছে। ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম তথা স্কুল কলেজের পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন করার সময় পাঠ্যক্রম তৈরী করতে যদি এত তাড়াহুড়ো করতে হয়, তাহলে তারা সারা বছর করে কী? এটি কি এমন যে জানুয়ারিতে বই দিতেই হবে, ডিসেম্বরের মধ্যে সব শেষ করতে হবে? এর ফলে এক ধরনের অসর্কতা দেখা দেয়। এর ফলে দেখা যায়, কোনো কোনো লেখকের মধ্যে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, কারো কারো মধ্যে চৌর্য্যবৃত্তি। এগুলোর যদি আমরা পাঠ্য পুস্তকে প্রতিফলন দেখি তাহলে তারচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। আমাদের পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে কিছু জিনিস ফান্ডামেন্টাল। এটি মনে রাখতে হবে। সেটি হলো, আমি কোনো ধর্মের প্রতি বিরাগ সৃষ্টি করবো না। আমাদের দেশের সংবিধানের অন্যতম জিনিস হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। সংবিধানে আরো বলা হয়েছে যে সকল ধরনের সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটাতে হবে। এই পটভূমিতে পাঠ্য পুস্তকে বিতর্কিত, বিভ্রান্তিকর এবং অগ্রহণযোগ্য মুসলিম শাসকদেরকে নিচু করার চেষ্টা করবো কেন? এর মাধ্যমে কী ম্যাসেজ থাকতে পারে? কোনো ধর্মের ক্ষেত্রেই আমরা এটা করতে পারবো না।”

॥ তিন ॥
প্রিয় পাঠক, মনে হচ্ছে আমরা কোনো বাংলাদেশী পাঠ্য পুস্তক পাঠ করছি না। মনে হচ্ছে, আমরা ভারতীয় পাঠ্য পুস্তক পাঠ করছি। বিশেষ করে বিজেপি সরকার প্রণীত কোনো পাঠ্য পুস্তক পাঠ করছি। কারণ এই বিজেপি আমলেই অফিসিয়ালি ভারতের সমস্ত মুসলিম শাসককে বহিরাগত, লুটেরা এবং অত্যাচারী বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। অথচ সঠিক ইতিহাস তার বিপরীত।

ভারতের ইতিহাস পাঠ করলে আমরা কম সে কম সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার বছরের ইতিহাস পাঠ করতে পারি। সেখানে আমরা দেখি কিভাবে বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচার করা হয়েছে। কিভাবে বৈদিক সভ্যতা প্রচারিত হয়েছে। ঋক বেদ এবং উপনিষদকে কিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে। ভারতের ইতিহাসে তো মগধ রাজ্য, হর্ষের সা¤্রাজ্য, কনিষ্ক সা¤্রাজ্য মহাজনপদ এবং মারাঠা সা¤্রাজের কথাও বিধৃত আছে। মৌর্য্য সা¤্রাজ্য, মারাঠা সা¤্রাজ্য, নন্দ সা¤্রাজ্য, সেন ও পাল বংশ, সংস্কৃতির মহাকাব্য, হুনদের আগমন, গুপ্ত সা¤্রাজ্য ইত্যাদি দেখেছি। এর পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই দিল্লী সালতানাত, বাংলা সালতানাত এবং মুঘলদের শাসন। আলেকজান্ডারও তো ভারতে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি তো এখানে বাস করেননি।

কিন্তু মুসলমানরা মধ্য এশিয়া থেকে এলেও শত শত বছর এখানে থেকে গেছেন। ভারতকেই তারা তাদের স্থায়ী ঠিকানা করেছেন। একথা স¤্রাট বাবরের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমন হিন্দুরা যাকে শত্রু মনে করে, সেই স¤্রাট আওরঙ্গজেবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আজ ভারতবর্ষের যেসব ঐতিহাসিক স্থান বিশ^ব্যাপী পরিচিত এবং ঐতিহ্যবাহী, মুঘলদের যেসব স্থাপত্য এবং স্থাপনা বিশ্বসভ্যতায় স্থায়ী আসন করেছে, সেগুলো তো এখানে স্থায়ীভাবে বাস করার কারণেই হয়েছে। অন্যান্য যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো বলে শুরুতে বলেছিলাম, স্থানাভাবে সেগুলো করা সম্ভব হবে না।

শেষ করার আগে একথা বলতে চাই যে, আজ ভারতের যে ভৌগোলিক আয়তন, ২৮টি প্রদেশ তথা রাজ্য অধ্যুষিত সেই বিশাল ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণে মুসলমান শাসকদের ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। সেই ইতিহাস বিকৃত করা হিন্দুত্ববাদী ভারতের পক্ষে সম্ভব হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে কেমন করে সেটি সম্ভব? বাংলাদেশের সর্বশেষ আদমশুমারী, যার খসড়া প্রকাশিত হয়েছে গত বছর, সেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠী হলো মোট জনগোষ্ঠীর ৯২ শতাংশ। আর হিন্দু জনগোষ্ঠী হলো মাত্র ৮ শতাংশ। বিশ্বাস না হলে এই আদমশুমারীতে চোখ বুলান। সেই ৯২ শতাংশ মুসলমানকে অবজ্ঞা করে বিজেপির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে ৮ শতাংশকে খুশি করার অপচেষ্টা যারা করছেন তারাই এদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছেন।
অন্যান্য বিষয় এবং এই বিষয়ে আরো কিছু লেখার এরাদা করে আজকে শেষ করছি।

https://dailysangram.com/post/515707