৩০ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ৮:৪৬

চার কারণে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে জুনে

শেষ প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি ৬.৯৬% প্রত্যাশা * দ্রুত সহনীয় হবে বলা যাচ্ছে না

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ ৪ কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। অন্য কারণগুলো হচ্ছে-বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী। অর্থ বিভাগের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য। সেখানে আরও বলা হয়, বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির মূল্য ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এটি নিয়ামক হিসাবে কাজ করবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে। এর ফলে আগামী জুন নাগাদ দেশের মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে।

প্রসঙ্গত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ বলেছে, আগামী কয়েক বছর বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়বে। ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে বাড়বে মূল্যস্ফীতির চাপ। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াতে পারে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে দাঁড়াতে পারে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।

অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, অর্থনীতিতে পুনরায় নানাবিধ বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। তবে আমি আশাবাদী এসব বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দেশ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।

জানতে চাইলে বিআইডিএস’র সাবেক ডিজি এম কে মুজেরি রোববার যুগান্তরকে জানান, বিশ্ব অর্থনীতি এখন অনিশ্চিত। আদৌ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামবে, না আরও বাড়বে, কতদিন যুদ্ধ চলবে কিছুই কেউ বলতে পারছে না। ২০২৩ সালের বিশ্ব অর্থনীতি সুখকর নয়, এমন পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এমনটিও আভাস নেই। অপরদিকে ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল, গমসহ অনেক পণ্যে আমরা বেশিরভাগ আমদানি নির্ভরশীল। এসবের মূল্য কবে কমবে কেউ বলতে পারছে না। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কিছুটা বাড়লেও আগামী দিনগুলোতে এর ধারাবাহিকতা থাকবে কিনা-সেটিও নিশ্চিত নয়। ফলে দেশে এবং দেশের বাইরের পরিস্থিতি অনিশ্চয়তায় ভর্তি। সামনে কোনো উজ্জ্বল হওয়ার আভাস নেই। ফলে আগামী জুনে মূল্যস্ফীতি কমবে সেটিও বলা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, অর্থবছরের প্রথম মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। যা আগের অর্থবছরে একই সময় ছিল ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জুলাইয়ের পর থেকে মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমে আরও বাড়তে থাকে। তবে গড় মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করে গত অক্টোবরে। সর্বশেষ গত ডিসেম্বর মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। অর্থ বিভাগের হিসাবে আগামী জুনে মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় পর্যায়ে নেমে দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাস, বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, গম, ভোজ্যতেলসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। ফলে দেশে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। সিএন্ডএফ’র তথ্য মতে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিদেশে থেকে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৯০ কোটি মার্কিন ডলার। এটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। এই সময়ে আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয় ১ হাজার ৮৫৮ কোটি (১৮.৫৮ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের। কিন্তু একই সময়ে ডলারের মূল্য অধিক বৃদ্ধি পায়। এই আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিজনিত প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতি।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, করোনার প্রভাব কাটিয়ে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শক্তিশালী হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এতে দেশের ভেতরও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করতে হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেল, গম, সার, ভোগ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামালসহ বিশ্ববাজারে পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ সৃষ্টি হয়। যদিও একই সময়ে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও স্মরণকালের উচ্চ মূল্যস্ফীতির রেকর্ড সৃষ্টি হয়।

তবে মূল্যস্ফীতির চাম কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পথ অনুসরণ করা হয়। এছাড়া আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে এনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষা দেওয়া হয়। পাশাপাশি আমদানির বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে নতুন পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালু করা হয়েছে। এছাড়া বিলাস জাতীয়, বিদেশি ফল, অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে এলসি মার্জিন হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়। নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার কারণে অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে আমদানি ব্যয় আরও হ্রাস পাবে-এমনটি প্রত্যাশা করছে অর্থ বিভাগ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা উল্লেখ করে আরও বলা হয়, কৃষি, রপ্তানিমুখী শিল্প, কুটির শিল্প, মাঝারি শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন ঋণ দেওয়া অব্যাহত আছে। আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে এনে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়িয়ে বিনিয়োগের গতিধারা ঠিক রাখার চেষ্টা চলছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/639894