৩০ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ৮:৪৪

সিপিডি ও সিজিএস’র জরিপ

ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধা দুর্নীতি

দেশের ৭৪ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সরাসরি দুর্নীতির শিকার। করোনা-পরবর্তী সময়ে এটি আরও ভয়াবহভাবে বেড়েছে। লাইসেন্স গ্রহণ ও কর পরিশোধে সবেচেয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। ব্যবসা শুরুর লাইসেন্স পেতে ও নবায়ন করতে ১৪-১৫টি ঘাটে ঘুস দিতে হয়। অপরদিকে ৬৪ শতাংশ কর্মকর্তা কর প্রদানে, ৫৪ শতাংশ ব্যবসায়িক লাইসেন্স নিতে, ৪৯ শতাংশ গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ নিতে এবং ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তা মনে করেন আমদানি-রপ্তানিতে দুর্নীতি হচ্ছে। মোট কথা, দুর্নীতি এখন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। ৪৪ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, টাকা পাচার ঠেকানো এখন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতে, অপ্রয়োজনীয় বড় প্রকল্প পরিহার করা দরকার।

সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পৃথক দুই জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে। গত বছরের ২৭ জুন থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ বিভাগের ১৯৪ জন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জরিপ তৈরি করেছে সিজিএস। রোববার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত সেমিনারে জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়।

অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মফিজুর রহমান, এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ প্রমুখ।

অপরদিকে সিপিডির জরিপে বলা হয়েছে, দেশে ব্যবসায় এখন বড় বাধা দুর্নীতি। তার সঙ্গে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, যথেষ্ট ঋণ না পাওয়া এবং অদক্ষ প্রশাসন নিয়েও রয়েছে দুশ্চিন্তা। এসব সমস্যার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট ও অস্থায়ী নীতি ব্যবসার পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলেছে। শুধু তাই নয়, এ সময় দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচারও হয়েছে।

সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ ২০২২’ উদ্যোক্তা জরিপে আরও দেখা যায়, ২০২১-এর তুলনায় ২০২২ সালে ব্যবসার পরিবেশের অবনতি হয়েছে বেশি। রাজধানীর ধানমন্ডি সিপিডির কার্যালয়ে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে জরিপের তথ্য তুলে ধরেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের কৃষি, উৎপাদন ও সেবা খাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৭৪ জন পদস্থ কর্মকর্তা ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুলাইয়ে করা এ মতামত জরিপে অংশ নেন। সেই হিসাবে এটি জাতীয় প্রতিনিধিত্বশীল জরিপ নয়।

জরিপে অংশ নেওয়া ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ কর্মকর্তা দুর্নীতিকে ব্যবসার বড় বাধা হিসাবে উল্লেখ করেন। কোনো কোনো জায়গায় দুর্নীতি হচ্ছে, সেটিও জরিপে উঠে এসেছে। ৬৪ শতাংশ কর্মকর্তা কর প্রদানে, ৫৪ শতাংশ ব্যবসায়িক লাইসেন্স নিতে, ৪৯ শতাংশ গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ নিতে এবং ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তা আমদানি-রপ্তানিতে দুর্নীতির কথা বলেছেন। এছাড়া ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ দুর্নীতির পাশাপাশি ব্যবসার জন্য দুর্বল অবকাঠামো, ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ ব্যাংক ঋণের অপর্যাপ্ততা ও অদক্ষ প্রশাসন, ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা, ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ নীতি ধারাবাহিকতার অভাব, ২৬ দশমিক ২ শতাংশ জটিল করব্যবস্থা ও উচ্চ করহার, ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ দুর্বল নীতিনৈতিকতা ও সরকারে স্থিতিশীলতার অভাব, ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ অপরাধ ও উদ্ভাবনে অপর্যাপ্ত সক্ষমতা এবং ১০ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মকর্তা শ্রমসংক্রান্ত নিয়মনীতির সীমাবদ্ধতাকে সমস্যা হিসাবে উল্লেখ করেন।

অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সারা বিশ্ব এখন একটি অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত মন্দাভাব থাকবে। বাংলাদেশের মানুষ মূল্যস্ফীতির কারণে হাবুডুবু খাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা এক ধরনের চাপে রয়েছে।

সিপিডির গবেষণার পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম তার উপস্থাপনায় বলেন, দুর্নীতির কারণে শুধু উৎপাদন খরচ নয়, সেবার মূল্যও অনেকখানি বেড়ে যায়। এই মূল্যের ঘানিটা সাধারণ মানুষেরই ওপর পড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতি হলে শুধু ব্যবসার পরিবেশ নয়, অর্থনৈতিক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। এসএমই উদ্যোক্তারা ঋণ পায় না। এক্ষেত্রে সুদের হার কমিয়ে দেওয়া দরকার। পুঁজিবাজারে আগের মতোই দুর্বলতা রয়েছে। আর্থিক খাতে সুশাসন আনার ক্ষেত্রে সরকার যে আশ্বাস দিয়েছে, বিশেষ করে ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আইএমএফের সঙ্গে সরকার সুশাসনের যে কথা দিয়েছে, সেখান থেকে কাজ শুরু হতে পারে। আর্থিক খাত সংস্কারের অংশ হিসাবে ঋণখেলাপি আরও কমিয়ে আনা প্রয়োজন। এফডিআই অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে সেরকম সম্ভাবনা দেখছি না।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ব্যাংক খাত ও অর্থঋণ আদালতের সংস্কার প্রয়োজন। দেশের বন্দরের কর্মীদের অধিকাংশ ব্যবসায়ী যথেষ্ট দক্ষ মনে করেন না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হচ্ছে। ৪৪ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, টাকা পাচার ঠেকানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতে, অপ্রয়োজনীয় বড় প্রকল্প পরিহার করা দরকার। আর ২০ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধ করতে হবে। শেয়ারবাজারসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের পুঁজিবাজার একটা অদক্ষ বাজারে পরিণত হয়েছে।

এছাড়া সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের জরিপে দেখা গেছে, ৭৪ শতাংশ এসএমই উদ্যোক্তাই ব্যবসা করতে গিয়ে সরাসরি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। ঘুস ও রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে সুবিধা গ্রহণ করা-এ দুটি বিষয়ই দেশে দুর্নীতির সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রূপ। ব্যবসা শুরুর লাইসেন্স পেতে ও নবায়ন করতে ১৪-১৫টি সংস্থার অনুমতি নিতে হয়। জটিলতা এড়াতে অনেক ব্যবসায়ী লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা করছেন। যারা লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করেন, তাদের লাইসেন্স পেতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুস দিতে হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতির খাত হলো কর পরিশোধ না করার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা। কর সংগ্রহকারী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের যোগসাজশের ফলে অন্যদের ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে বহু প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়। কাস্টমসে পণ্য খালাসে ঘুস স্বাভাবিক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোট কথা, ঘুস ছাড়া কাস্টমসে পণ্য খালাস করা যায় না।

জরিপের ফলাফলের ওপর আলোচনায় সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দুর্নীতি অবশ্যম্ভাবীভাবে দারিদ্র্যকে স্থায়ী করে, আয়বৈষম্য সৃষ্টি করে, মানুষের অধিকারহীনতা সৃষ্টি করে, দক্ষতাকে নষ্ট করে, বিনিয়োগ নষ্ট করে এবং সমাজের ভেতরে আস্থার সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়। দুর্নীতি সমাজকে দুর্বল করে, সামাজিক সংহতি নষ্ট করে, বিশ্বাস ভঙ্গ করে। মধ্য মেয়াদে একটি উদীয়মান অর্থনীতির জন্য দুর্নীতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি আরও বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে। এগুলোর হওয়া দরকার ছিল সমর্থনমূলক প্রতিষ্ঠান।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান আচরণ দেখা না গেলে দুর্নীতি প্রশমন করা ক্ষুদ্র নাগরিকদের পক্ষে কষ্টকর হবে। দুর্নীতিকে যদি রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে দুর্নীতি বন্ধ করা কঠিন হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে এ খাতসংশ্লিষ্ট সবাইকে একত্রিত কণ্ঠস্বর থাকতে হবে

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, যে দেশে-সমাজে অন্যায়ভাবে টাকা উপার্জন করে ভোগ করার সুযোগ থাকবে, সেই সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করা যাবে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা এর কাছাকাছি স্তরে পৌঁছে গেছি বলে মনে হয়। এককালে সুইস ব্যাংকে টাকা রাখার কথা শুনলাম, পরে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম, কানাডার বেগমপাড়ার কথা শুনেছি। এখন দুবাই, লন্ডনে বাড়ির কথা শুনছি। বিদেশে সম্পত্তি কিনতে যারা টাকা নিয়ে গেছেন, তারা সেই টাকা যথাযথভাবে অর্জনও করেননি এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিদেশেও পাঠিয়ে দেননি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে না পারলে দুর্নীতি দূর করা যাবে না।

এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, অবস্থা এমন-সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা? ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পে দুর্নীতি কেন এতদূর গেল, সেটি আগে খুঁজে বের করা দরকার। প্রতিটি পদে আজ নিয়োগ পেতে হলে টাকা ঢালতে হয়-স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে রাজস্ব বোর্ড পর্যন্ত। আবার কেউ বাধ্য হয়েও খাচ্ছেন। সমস্যাটা ওপর থেকেই শুরু। সেখানে বন্ধ না হলে এর থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/639887