৩০ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ৮:৩৯

বায়ুদূষণ পরিস্থিতি ভয়াবহ

-আশিকুল হামিদ

বাংলাদেশের দ্রুত অবনতিশীল পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আবারও এমন কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলোকে শুধু আশংকাজনক বলা যথেষ্ট নয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে হলে একই সঙ্গে ভীতিকর এবং ভয়াবহ ধরনের শব্দেরও ব্যবহার করা দরকার। গতকাল, ২৯ জানুয়ারির একই দিনে দুটি জাতীয় দৈনিক পরিবেশ সম্পর্কিত রিপার্ট প্রকাশ করেছে। দুটির মধ্যে একটি দৈনিক ‘ঢাকায় নিশ্বাস নিলেও বিপদ’ শিরোনামে তার প্রধান রিপোর্টে জানিয়েছে, বায়ুদুষণের কারণে রাজধানী ঢাকার অধিবাসীদের গড় আয়ু সাত থেকে আট বছর কমে যাচ্ছে এবং ঢাকার পাশাপাশি সারাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটছে।

এ সম্পর্কিত অন্য এক তথ্যে রিপোর্টটিতে জানানো হয়েছে, চলতি মাস জানুয়ারির ২৪ দিনের মধ্যে ২৩ দিনই রাজধানী ঢাকার বায়ুর মান ছিল ‘বিপদজনক’। উল্লেখ্য, বেশ কয়েক বছর ধরেই ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীগুলোর মধ্যে অন্যতম একটির অবস্থান অর্জন করেছে। যেমন ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর। কোনো শহরের বায়ু দূষণের মাত্রা ৫০ পর্যন্ত হলেই যেখানে শহরটিকে অস্বাস্থ্যকর ও বিপদজনক হিসেবে গণ্য করা হয় সেখানে ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার দূষণের মাত্রা ছিল ১৯৪। এমন অবস্থা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ভীতিকর। একই কারণে দেশের অভ্যন্তরে তো বটেই, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশ সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সেই সাথে দূষণমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। কিন্তু সব জানার পরও সরকার এবং কোনো সংস্থার পক্ষ থেকেই দূষণমুক্ত পরিবেশের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ফলে পরিবেশের আরো অবনতি ঘটেছে।

বাংলাদেশের দূষণ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার জন্য বিটিভিসহ দেশের সকল টেলিভিশনে প্রচারিত যে কোনো দিনের যে কোনো খবরের দিকেই লক্ষ্য করা যেতে পারেÑ যেখানে সড়ক-মহাসড়কের দৃশ্য দেখানো হয়। সংবাদপত্রেও প্রায় নিয়মিতভাবে এমন সব দৃশ্যের ছবি প্রকাশিত হয়, যেগুলোতে কেবল ধূলোবালি ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। যেমন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে মাঝে মধ্যেই চট্টগ্রামের এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের যেসব ছবি ছাপানো হয় সেসব ছবিতে ধূলোবালির কারণে এমনকি বাস ও ট্রাকের মতো বড় যানবাহনগুলোকেও দেখা যায় না। সেগুলো ধূলোবালির আড়ালে চলে যায়। মনে হয় যেন পুরো সড়ক জুড়েই ধূলোবালি উড়ছে! এমন অবস্থার কারণ শুধু ওই নির্মাণকাজ নয়। স্থানীয় জনগণের বক্তব্যে জানা গেছে, সড়ক নির্মাণ করার জন্য প্রথমে সেই প্যারাবন উজাড় করা হয়েছেÑ যে বন ও তার গাছপালার জন্য বিভিন্ন সময়ের ঘূর্ণিঝড়, সিডর, আইলা, আম্পান, ইয়াস এবং সবশেষে গত মাস অক্টোবরের সিত্রাংয়ের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি থেকে চট্টগ্রামের জনগণ রক্ষা পেয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সময় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থাই অতীতের কথা মনে রাখেনি। সে কারণে প্যারাবন সম্পূর্ণ উজাড় করা হয়েছে।

তথ্যাভিজ্ঞরা বলেছেন, মূলত একই কারণে বায়ুদূষণসহ পরিবেশের দিক থেকে বাংলাদেশের ক্রমাগত কেবল অবনতিই ঘটে চলেছে। এ প্রসঙ্গে গত বছর ২০২২ সালের মে মাসের একটি আন্তর্জাতিক জরিপের উল্লেখ করা দরকারÑ যেখানে জানানো হয়েছে, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৭৭ নাম্বারে নেমে এসেছে। দেখা গেছে, ২০২০ সালের সর্বশেষ জরিপে ১৬২ নাম্বার অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ এবার আরো ১৫ ধাপ পিছিয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য, মার্কিন সরকারের এই সংস্থাটি দুই বছর পরপর পরিবেশ ও আবহাওয়া বিষয়ক জরিপ রিপোর্ট তৈরি ও প্রকাশ করে। এবারের রিপোর্টে শীর্ষ পাঁচটি অবস্থানে রয়েছে ডেনমার্ক, ব্রিটেন, ফিনল্যান্ড, মাল্টা ও সুইডেন। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২০ সালে ১৭৮ নম্বরে থাকা আফগানিস্তান উঠে এসেছে ৮১ তম অবস্থানে। কিন্তু পতন ঘটেছে বাংলাদেশের।
উল্লেখ করা দরকার, বায়ুদূষণসহ পরিবেশের দিক থেকে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সকল আলোচনায় বাংলাদেশকে শুধু ‘প্রধান দূষিত নগরীর দেশ’ হিসেবেই চিহ্নিত করা হচ্ছে না, একই সঙ্গে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সম্পর্কেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। এর পেছনের বিশেষ কারণ সম্পর্কে মার্কিন রিপোর্টে বলা হয়েছে, তালিকার নিচের দিককার দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে পরিবেশসহ অন্য সকল বিষয়ে পিছিয়ে পড়ছে।

আশংকাজনক ওই রিপোর্টের পর আশা ও ধারণা করা হয়েছিল, সরকার নিশ্চয়ই পরিবেশ স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে উদ্যোগী হয়ে উঠবে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগই লক্ষ্য করা যায়নি। ফলাফল যা হওয়ার ঠিক তা-ই হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বায়ুদূষণের মাত্রা বরং অনেক বেড়ে গেছে। এ বিষয়ে ইংল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের রিপোর্টেও কিছুদিন আগে ‘বিশ্ব বাসযোগ্যতার সূচক-২০২১’ শিরোনামে ১৪০টি দেশকে নিযে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল সে রিপোর্টে নিচের দিক থেকে ঢাকার অবস্থান ছিল চার নাম্বারে। সে কারণে ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ওই রিপোর্টে বাসযোগ্যতার পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং অবকাঠামো বিষয়ক পাঁচটি উপসূচকেও বাংলাদেশের নাম্বার কমে গিয়েছিল।

ভীতি ও উদ্বেগের কারণ হলো, এত কিছুর পরও সরকারের পক্ষ থেকে দূষণ প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা তো নেয়া হচ্ছেই না, উল্টো ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল ধরনের নির্মাণ কাজের মাধ্যমে পরিবেশকে আরো বিপদজনক করে তোলা হচ্ছে। ফলে দূষণের সূচকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। বায়ুদূষণের পরিণতিতে জটিল ও দুরারোগ্য নানা অসুখ-বিসুখই কেবল ছড়িয়ে পড়ছে না, দেশে মৃত্যুর হারও বেড়ে চলেছে। এ সংক্রান্ত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে বাংলাদেশ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। একই কারণে দুরারোগ্য নানা অসুখ-বিসুখ তো বাড়ছেই, মানুষের আয়ুও অনেক কমে যাচ্ছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সব মিলিয়েই রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের দূষিত বায়ু ও পরিবেশ মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা যথার্থই বলেছেন, সরকারের উচিত বায়ুদূষণ প্রতিরোধের জন্য জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া। বিশেষজ্ঞদের এই অভিমতের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার পাশাপাশি আমরাও চাই, রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশ থেকে বায়ুদূষণের বিপদ দূর হোক এবং নিরাপদ হোক মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবন।

https://dailysangram.com/post/515105