২৯ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ৫:৫৮

খেলাপি ঋণের আসল চিত্র আড়ালে

আদায়ে কঠোর না হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তার সুযোগে ঋণ নিয়মিত দেখানোর পথ পেয়ে যাচ্ছেন খেলাপিরা। কখনও বিশেষ ব্যবস্থায় পুনঃতপশিল, কখনও পুনর্গঠনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের আসল তথ্য থেকে যাচ্ছে আড়ালে। ঋণ পরিশোধে শিথিলতার মধ্যেই ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে ১১ হাজার ৫১২ কোটি টাকা পুনঃতপশিল হয়েছে। গেল ১০ বছরে পুনঃতপশিল করা হয়েছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। এর পরও গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণ স্থিতির ১২ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অবশ্য একই ব্যক্তির মালিকানার একাধিক প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় নিলে অর্থমন্ত্রীর তালিকাটি ১৬ খেলাপির। তালিকায় ক্রিসেন্ট গ্রুপের তিনটি, মাইশা গ্রুপের দুটি এবং এসএ গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান আলাদাভাবে দেখালেও মালিকানা একই। শীর্ষ এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা ১৯ হাজার ২৮৪ কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
প্রশ্ন উঠেছে, ব্যাংক খাতের শীর্ষ খেলাপিদের কাছে এত কম পাওনা কেন। সংশ্নিষ্টরা জানান, খেলাপি ঋণের আসল চিত্র প্রকাশ হলে তাঁদের কাছে পাওনার অঙ্ক আরও অনেক বেশি হতো। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে এক টাকাও পরিশোধ না করেই খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। পরের দুই বছরে একজন ঋণগ্রহীতার যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা, তার আংশিক দিলে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত না করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন শিথিলতার মধ্যেই ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ ৩১ হাজার ১২২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা হয়। আর অবলোপনের মাধ্যমে ব্যাংকের স্থিতিপত্র থেকে আলাদা করে দেখানো খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪৩ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। এর বাইরে ঋণের একটি অংশ আছে যা অনাদায়ী, তবে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাংকগুলোকে খেলাপি দেখাতে হচ্ছে না। এসবের কারণে দেশের শীর্ষ খেলাপি আসলে কারা কিংবা প্রকৃত খেলাপি ঋণ কত, তা জানা যাচ্ছে না। কিছু মানুষের হাতে ঋণ আটকে যাওয়ায় অর্থনীতি বা কর্মসংস্থানের আশানুরূপ বিস্তারও ঘটছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো গেল ১০ বছরে যে ২ লাখ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতপশিল করেছে। এর বেশিরভাগই হয়েছে বিশেষ সুবিধা নিয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে শিথিল শর্তে পুনঃতপশিল হয় ২০১৯ সালে। আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৮ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর ঘোষণা দেন, খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। এর পর বাংলাদেশ ব্যাংক মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট, সুদ মওকুফ সুবিধা, এক বছর পর কিস্তি পরিশোধ শুরু বা গ্রেস পিরিয়ড দিয়ে ১০ বছরের জন্য পুনঃতপশিলের সুযোগ দেয়। ওই বছর পুনঃতপশিল হয় রেকর্ড ৫২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৫ সালে ব্যাংক খাতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে, বিশেষ ব্যবস্থায় এ রকম বড় ঋণ ১২ বছরের জন্য পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়। ওই সুবিধায় ১১ গ্রুপের ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকা নিয়মিত করা হয়। বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতপশিলের সুযোগ ব্যাপক আকারে দেওয়া হয় ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর। ডাউনপেমেন্টের শর্ত শিথিল করে ওই বছর ১৮ হাজার ২০ কোটি টাকা নিয়মিত হয়। মূলত এই নীতিমালার পর থেকে বেশিরভাগ ঋণই নিয়মিত হয়েছে বিশেষ ছাড়ে।
অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারা গ্রেস পিরিয়ড বা ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় নতুন উপায় বের করেছেন।

জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী সমকালকে বলেন, নানা উপায়ে সময় বাড়িয়ে নিয়মিত দেখানো হলেও আসলে এসব ঋণ নিয়মিত নয়। এভাবে নিয়মিত রাখার সংস্কৃতি পুরো ব্যাংকিং খাতের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে এক সময় অনাদায়ী ঋণখেলাপি হিসেবে দেখাতে হবে। তখন একবারে চাপ তৈরি হবে। যে কারণে আস্তে আস্তে এসব ঋণের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করা উচিত। তিনি বলেন, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কোনো প্রতিষ্ঠান বা খাত সুবিধা পেতে পারে। তাই বলে ঢালাওভাবে বছরের পর বছর সুবিধা দেওয়া ঠিক নয়। এ রকম ঢালাও সুবিধা দিলে অনেক সময় ভালো গ্রাহকও নিয়মিত ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত হন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, বারবার সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণ কমানো ঠিক হচ্ছে না। করোনার সময় শিথিলতার বিষয়টি হয়তো ঠিক ছিল। তবে এর আগে ও পরে সুবিধা দিয়ে যেভাবে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হচ্ছে, তাতে আসল চিত্র বোঝা যাচ্ছে না। জনগণের টাকায় বড়দের সুবিধা দিয়ে কারও উপকার হচ্ছে না। এভাবে সুবিধা না দিয়ে কঠোর হয়ে ঋণ আদায় জোরদার করতে হবে। এর ফলে সতর্কতামূলক বার্তা যাবে। তখন তারা সাবধান হয়ে ঋণ পরিশোধে জোর দেবে। ঋণের টাকার অপব্যবহার বন্ধ হবে। ব্যাংকগুলোও দেখেশুনে ঋণ দেবে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ব্যাংকগুলো সবসময়ই খেলাপি ঋণ পুনঃতপশিল করতে পারে। আগে কোনো ঋণ তিনবারে সর্বোচ্চ ৭২ মাসের জন্য পুনঃতপশিল করা যেত। প্রতিবার পুনঃতপশিলে ১৫ থেকে ৫০ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিতে হতো। গত জুলাইয়ে আগের নীতিমালা শিথিল করা হয়। ডাউনপেমেন্ট কয়েক গুণ কমানোর পাশাপাশি প্রভাবশালী হিসেবে বিবেচিত ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ চার দফায় পুনঃতপশিলের সুযোগ দেওয়া হয়।
নিয়মিত দেখালে কার লাভ, কার ক্ষতি: ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারেন না। রপ্তানি করতেও নানা সমস্যায় পড়েন। নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য হন। অন্যদিকে, ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের বিপরীতে আয় দেখাতে পারে না। উল্টো অন্য আয় থেকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় চার্জ বেড়ে যায়। অনেক বেশি খেলাপি হলে ভালো ব্যাংক ব্যবসা করতে রাজি হয় না। বছরের পর বছর খেলাপিদের নানা ছাড় দেওয়ার পেছনে এগুলো অন্যতম কারণ। এর প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক খাত শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পারছে না। আবার কিছু মানুষের হাতে ঋণের টাকা আটকে পড়ায় সামগ্রিকভাবে তারল্য সংকট থেকে যাচ্ছে। আশানুরূপ নতুন কর্মসংস্থান বা উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না।

পুনর্গঠন করা ঋণ আবার খেলাপি: পুনর্গঠন সুবিধার অন্যতম লক্ষ্য ছিল ব্যাংক খাতে বড় খেলাপিমুক্ত করা। ওই সুবিধার প্রধান শর্ত ছিল- প্রতিষ্ঠানগুলোর নগদ প্রবাহের ভিত্তিতে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই করতে হবে। পুনর্গঠন সুবিধা নেওয়া ঋণ আর কখনও পুনঃতপশিল করা যাবে না। কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে এক বছর পর। এর পরও কোনো ঋণখেলাপি হলে সব সুবিধা বাতিল করে ব্যাংকগুলো দেউলিয়া আইনে মামলা করতে পারবে। এ রকম সুবিধার পরও অর্থমন্ত্রীর শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকায় চার প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন সুবিধা পাওয়া। এর মধ্যে রাইজিং স্টিলের কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা এক হাজার ১৪৩ কোটি। এসএ অয়েল রিফাইনারির কাছে এক হাজার ১৭৩ কোটি, সামান্নাজ সুপার অয়েলের কাছে এক হাজার ১৩১ কোটি এবং বিআর স্পিনিংয়ের কাছে ৭২১ কোটি টাকা। এর বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণ শোধ না করেও খেলাপিমুক্ত আছে।

https://samakal.com/economics/article/2301153792