২৯ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ৫:৫৩

গ্যাস লিকেজের আগুনে সপরিবারে দগ্ধ বাড়ছে

গত ৭ জানুয়ারি ভোর। ঢাকার ধামরাই উপজেলার ইসলামপুর এলাকার একটি বাসায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে দুই বছরের শিশুসহ পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের সবাই দগ্ধ হয়। ওই বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে বাস করছিলেন মনজুরুল ও জোসনা দম্পতি। দগ্ধ সবাইকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় একে একে সবাই মারা যায়। এভাবে মাত্র ১০ দিনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় একটি পরিবার।

পুলিশ জানায়, গ্যাস সিলিন্ডারের লিকেজ থেকে নির্গত গ্যাস জমা হয়ে তা থেকে ওই বিস্ফোরণ ও আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।
রাজধানীসহ সারা দেশে রান্নার জন্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত গ্যাসের সিলিন্ডার ও পাইপের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ এবং আগুন লাগার দুর্ঘটনা বাড়ছে। এতে একই পরিবারের সদস্যরা দগ্ধ হচ্ছে বেশি। কয়েকটি দুর্ঘটনায় জোসনা-মনজুরুলের পরিবারের মতো গোটা পরিবার শেষ।

মারা যাওয়া মনজুরুলের মা মোহসিনা বেগম (৫৫) বলেন, ‘ঘটনার পর জানতে পারি, পাইপ লিকেজ থেকে এই দুর্ঘটনা ঘটে। যদি আমরা গ্যাস ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন থাকতাম, তাহলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না। এভাবে একটা পরিবার একেবারে শেষ হয়ে যেত না। এ জন্য বলব, প্রত্যেকের গ্যাস ব্যবহারের নিয়ম-কানুন মেনে চলা উচিত।’

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, পাইপলাইনের লিকেজ থেকে রান্নাঘরে গ্যাস জমে যায়। বিশেষ করে যেসব রান্নাঘরে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা নেই। এসব রান্নাঘরে পাইপের ছিদ্র দিয়ে আসা গ্যাস বেরোতে পারে না। এক পর্যায়ে বাড়ির মানুষ যখন চুলায় দিয়াশলাই বা লাইটারে আগুন জ্বালায়, সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আগুন লাগে এবং জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

গত ৫ ডিসেম্বর ভোরে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গ্যাসের আগুন থেকে বিস্ফোরণে একই পরিবারের চারজন দগ্ধ হয়। পরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জসিম উদ্দিন (৪৩) ও আফরোজা আক্তার (৩৮) দম্পতির মৃত্যু হয়। অন্য দুজন চিকিৎসার পর সেরে উঠেছেন।

গত ৩০ আগস্ট সকালে ঢাকার কেরানীগঞ্জের জিনজিরা মান্দাইল এলাকার একটি বাসায় চুলার লিকেজ থেকে নির্গত গ্যাসের আগুনে ছয় সদস্যের একটি পরিবারের সবাই দগ্ধ হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন সবার মৃত্যু ঘটে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. এস এম আইউব হোসেন বলেন, গ্যাস লিকেজের ঘটনায় সাভারের ধামরাই থেকে পাঁচজন দগ্ধ রোগী এসেছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় একে একে সবাই মারা যান। এর আগেও এ ধরনের একাধিক ঘটনায় গোটা পরিবারে সব সদস্য মারা গেছেন। এসব ঘটনা খুব উদ্বেগজনক। তাই গ্যাস লিকেজের বিষয়ে সবার সতর্ক থাকা উচিত।

সম্প্রতি দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা কেন্দ্র শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়ে রোগীদের বেশ ভিড় দেখা যায়। একাধিক রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রান্না করার সময় অসতর্কতা, শীতে আগুন পোহানোর সময় অসাবধানতা, গরম পানি বহনের সময় দুর্ঘটনা, বিদুৎস্পৃষ্ট হওয়া—এসব কারণে দগ্ধ রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসেছে। এর বাইরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও গ্যাস লিকেজ থেকে আগুন লাগার ঘটনায় দগ্ধ রোগীরাও আছে।

বার্ন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে এখানে ঘরে-বাইরে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় শিশুসহ নারী-পুরুষ মিলিয়ে মোট ৮৩ হাজার ২৪৫ জন দগ্ধ রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ৪৫ হাজার, মহিলা ৩৮ হাজার ২৪৫ জন। ছয় হাজার ৪২৮ জনকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এক বছরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে ৯৮৪ জন।

বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসলাইনে যুক্ত হোস পাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস ভালভ ইত্যাদি দুর্বলতার কারণে যেকোনো সময় গ্যাস লিক বা ফুটো হতে পারে। সেই লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে জমতে থাকে। সামান্য আগুন, এমনকি স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে ঘটতে পারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। গ্যাস সিলিন্ডার, রেগুলেটর ও পাইপের মেয়াদ দেখে অনুমোদিত বিক্রেতাদের কাছ থেকে কেনা উচিত।

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের বিধিমালায় জ্বালানি গ্যাস ব্যবহারে কিছু সতর্কতার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এলপিজি সিলিন্ডার খাড়াভাবে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। সিলিন্ডার এমনভাবে রাখতে হবে, যাতে আশপাশে কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা না লাগে। সিলিন্ডার কোনো পাটাতনের ওপর নয়, বরং মাটিতে সমতল পৃষ্ঠে রাখতে হবে এবং চুলা সিলিন্ডার থেকে কমপক্ষে ছয় ইঞ্চি ওপরে রাখতে হবে। সিলিন্ডার কোনোভাবেই চুলার আগুনের খুব কাছে রাখা যাবে না। সিলিন্ডারটি লম্বা পাইপের সাহায্যে চুলা থেকে অন্তত তিন ফুট দূরে স্থাপন করতে হবে, যেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করে। সিলিন্ডার সরাসরি সূর্যের নিচে রাখা যাবে না। ছায়াযুক্ত শুষ্ক পরিচ্ছন্ন স্থানে রাখতে হবে। সিলিন্ডার যেখানে থাকবে, সেখানকার একটি জানালা সব সময় খোলা রাখার চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় ঘরের ওপরে ও নিচে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থা করতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডার পরিবর্তনের সময় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যেন চুলা চালু না থাকে। আগুন, বিদ্যুৎ ও তাপের যেকোনো রকম উৎস বিস্ফোরক পদার্থ এবং ভিন্ন কোনো গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে এই এলপিজি সিলিন্ডার দূরে রাখতে হবে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ভবনের কোথাও গ্যাস জমে এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় অনিয়মিত গ্যাস সরবরাহের কারণে বাসার চুলার চাবি বন্ধ করা হয় না। পরে রাতের যেকোনো সময় গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে রান্নাঘরটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়। ভোরে বা যেকোনো সময় সেখানে আগুন জ্বাললে সঙ্গে সঙ্গে ঘটে বড় দুর্ঘটনা।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক (ঢাকা) দিনমনি শর্মা কালের কণ্ঠকে বলেন, গ্যাস লিকেজ থেকে নানা কারণে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এর মধ্যে ব্যক্তি অসচেতনতা ও সিলিন্ডার রেগুলেটরগুলো নিয়মিত সার্ভিসিং না করা অন্যতম দায়ী। এ ক্ষেত্রে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আমরা গণসংযোগের মাধ্যমে এসব বিষয়ে নিয়মিত সচেতন করে থাকি। বলে থাকি, লিকেজের বিষয়টি নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। ঘর যেন গ্যাস চেম্বারে পরিণত না হয়, এ জন্য চুলা জ্বালানোর আগে ঘরের সব দরজা-জানালা খুলে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে ২০ মিনিটের মতো অপেক্ষা করতে হবে। এরপর চুলা জ্বালাতে হবে। তাহলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।
গতকাল তিতাস গ্যাসের মেট্রো ঢাকার রাজস্ব ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক মো. রশিদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, তিতাস গ্যাস বিতরণ এলাকায় পাইপলাইনের যত রকমের লিকেজ আছে, সে লিকেজ বন্ধ করতে নিয়মিত কাজ করা হচ্ছে। নিজ উদ্যোগের পাশাপাশি অভিযোগ পাওয়া মাত্রই ঘটনাস্থলে গিয়ে লিকেজ বন্ধসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি, যাতে লিকেজ থেকে কোনো রকম দুর্ঘটনা না ঘটে। একই সঙ্গে পুরনো পাইপলাইন সরিয়ে নতুন পাইপলাইন স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যয় হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা। তবে এটি সময়সাপেক্ষ।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/29/1238612