২৯ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ৩:০১

এক পা এগিয়ে দুই পা পিছু হটা কেন?

-আসিফ আরসালান

গত ২১ জানুয়ারি শনিবার একটি বাংলা সহযোগী তাদের একটি উপসম্পাদকীয় কলামের হেডিং দিয়েছেন অনেকটা এরকম, ‘বিএনপি আন্দোলনে নেমে এক পা এগিয়ে চার পা পিছিয়ে যাচ্ছে’। প্রথমেই বলে রাখি যে এই শিরোনাম বা নিবন্ধে বর্ণিত বক্তব্য ব্যক্তিগতভাবে আমার বা দৈনিক সংগ্রামের নয়। দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি দৈনিক সংগ্রামে আমি কলাম লিখছি। সেই একই শিরোনামে অর্থাৎ ‘অবগুন্ঠণ উন্মোচন’ এই শিরোনামে। কিন্তু এই সুদীর্ঘ ২০ বছরে আমি অন্য কোনো পত্রিকার কলাম নিয়ে আলোচনা করি নাই। সাধারণত জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ইত্যাদি নিয়ে লিখেছি। কিন্তু আজ তার ব্যত্যয় ঘটালাম এজন্য যে বর্ণিত কলামে প্রদত্ত সবগুলো পয়েন্টের সাথে একমত হতে না পারলেও শিরোনামের সাথে সম্পূর্ণভাবে নয়, আংশিকভাবে আমি একমত। এই শিরোনামটি কমিউনিস্ট নেতা ভি আই লেনিনের একটি লেখা বা বক্তব্যের উদ্ধৃতি। অবশ্য লেনিন বলেছেন, এক পা এগিয়ে, দুই পা পিছিয়ে। এখানে ঐ পত্রিকায় বলা হয়েছে, এক পা এগিয়ে, চার পা পিছিয়ে। এটা হতেই পারে। রূপক অর্থে এধরণের বাক্য বা শব্দ প্রয়োগ করা যেতেই পারে। আমি ঐ একই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি একটু ভিন্ন কারণে।

কারণটি হলো, বিএনপি বেশ কয়েক মাস আগে থেকে বলছে, তারা দেশের আগামী সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাদের দাবি হলো, কোনো দলীয় সরকার অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। তারা নির্বাচনে যাবে একটি কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে। তারা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন করবে না। তারা নির্বাচন করবে কেয়ারটেকার সরকার বা ঐ ধরনের কোনো নির্বাচনকালীন সরকার যে ইলেকশন কমিশন গঠন করবে সেই কমিশনের অধীনে তারা নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। এখন কথা হলো, এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রী এবং কর্মীবৃন্দ অর্থাৎ দলের র‌্যাঙ্ক এ্যান্ড ফাইল এক কণ্ঠে বলছেন যে বর্তমান সংবিধানের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। এ ব্যাপারে তারা কোনো ছাড় দেবেন না।

তাহলে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে বিএনপির নির্বাচন করার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে কিভাবে? এই সংবিধানে এটাও আছে যে বর্তমান জাতীয় সংসদ বজায় থাকা অবস্থাতেই নির্বাচন হবে। তাই শুধু বিএনপি নয়, তার সহযোগীরাও দাবি করছেন যে নির্বাচনের আগে বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে। আর একথা অত্যন্ত স্পষ্ট যে এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করবো না, নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার বা এই ধরনের কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন করবো, সেই দাবি বাস্তবায়ন করতে গেলে সর্বাগ্রে যেটি করতে হবে সেটি হলো এই সরকারের পদত্যাগ। আর সরকার এ ব্যাপারে যে হার্ড লাইন নিয়েছে সেটা দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না যে এত সহজেই সরকার পদত্যাগ করবে না। সেক্ষেত্রে এই সরকারকে সরাতে হবে বা অপসারণ করতে হবে। সোজা কথা, সরকারকে হটাতে হলে গণঅভ্যুত্থানের মত প্রবল গণআন্দোলন করতে হবে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে পাঠক ভাইদের নিকট আমাদের নিরেট সত্যটি প্রকাশ করতে হবে। সেই নিরেট সত্যটি হলো এই যে আওয়ামী লীগ সরকার কিন্তু এরশাদ সরকারের মত নয়। এরশাদ সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। যত দিন সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছিল তত দিন অর্থাৎ ৯ বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন এরশাদ সামরিক বাহিনীর সমর্থন চান। তখন সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন লে: জে: নুরুদ্দিন। জেনারেল নুরুদ্দিন এরশাদকে সাফ জানিয়ে দেন যে জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী যাবে না। অন্য দিকে সংগঠন বলতে যা বোঝায়, জাতীয় পার্টি সেই রকম কোনো রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। তখন অবশ্য বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান আজকের মত এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তাই বিদেশী শক্তিসমূহ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ততখানি নাক গলায়নি। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের যে ইন্টারেস্ট সেটি জিও-পলিটিক্যাল। সেটি আগেও ছিল, এখনও আছে। এরশাদ ভারতপন্থী ছিলেন, এমন কথা সরাসরি বলবো না। তবে তিনি কথা এবং কাজে এমন কিছু করেননি বা বলেননি যেটি ভারতের বিরুদ্ধে যায়।

কিন্তু আজকের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আওয়ামী লীগ ৭৫ বছরের পুরাতন একটি রাজনৈতিক দল। এক সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি সারা দেশব্যাপী ছিল এবং সেই ভিত্তি ছিল সুদৃঢ়। এখন অবশ্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি আগের মত প্রবল নয়। কারণ এক টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে তাদের র‌্যাঙ্ক এ্যান্ড ফাইলে বড়লোক হওয়ার অর্থাৎ টাকা বানাবার নেশা উদগ্র হয়েছে। তাই দেখা যায়, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের ভাষায়, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার আগে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর পায়ে ছিল চপ্পল বা স্পঞ্জের স্যান্ডেল। আজ তারা দামি গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়। একটি সময় ছিল যখন টয়োটা করোনা মূল্যবান গাড়ি ছিল। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ আমলে বিএমডব্লিউ বা টয়োটা প্রাডোর মত কোটি টাকার গাড়ি তাদের অনেকে হাঁকায়। অনেকে হাঁকায় লেক্সাসের মত দামি গাড়ি।

এটি আমাদের কথা নয়। আপনি পত্রিকা খুললেই দেখতে পাবেন, একজন সাধারণ কর্মচারী, যিনি কেরানি বা বড়জোর জুনিয়র অফিসার, তাদের মত লোকও ঢাকায় ৮ তলা ১০ তলা দালান বানিয়েছেন। আরো কিনেছেন ২০০০ বর্গফুটের চেয়েও বড় এক বা একাধিক ফ্ল্যাট। দেশে কিনেছেন কয়েক একর ধানী জমি।
বিগত ১৪ বছরের পেপার কাটিং সংকলন করলে এই রকম হাজার হাজার নিউজ পাওয়া যাবে যেখানে দেখা যাবে যে একজন জেলা পর্যায়ের নেতাও ২ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। এই তো সেদিন আওয়ামী লীগের অফিস সেক্রেটারি গোলাপ নিউ ইয়র্কে একাধিক বাড়ি কিনেছেন যার মূল্য কম সে কম ৪০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তিনি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। এই রকম আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার নজির আওয়ামী লীগে সর্বক্ষেত্রে এবং হাজারে হাজারে। তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে যেমন রয়েছে, তেমনি বেসামরিক প্রশাসনেও তার ভুরি ভুরি নজির রয়েছে। এসব নিয়ে আর কথা বাড়াবো না। কারণ আপনারা সকলেই এসব জানেন।

তবে সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই যে, এই যে চুরি, এই যে লুণ্ঠন, এগুলো ধরার কেউ নাই। দেশের লুটপাট দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটি যেন ‘ফ্রি ফর অল’। আর দুর্নীতি, টাকা পাচার আওয়ামী লীগের শক্তির ভীতকে উইপোকার মত কুরে কুরে খেয়েছে। ফলে সাংগঠনিক শক্তি তাদের আর নাই। তারপরেও তাদের মিছিল মিটিংয়ে কিছু লোক আসেন। এদের প্রায় সবাইকেই আনা হয় নগদ নারায়ণের বিনিময়ে।

আওয়ামী লীগের এই দুর্বলতা চিহ্নিত করার পরেও বলতে হয় যে দুর্নীতি করে হোক, স্বজনপ্রীতি করে হোক বা দলের লোকজনকে চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্য, লুটপাট ইত্যাদি সুবিধা দিয়ে হোক, দলটি সমাজের তথা রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা ব্যবসায়ীদের গ্রাস করেছে, পুলিশকে গ্রাস করেছে, বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে গ্রাস করেছে। এর পাশাপাশি তারা দলে যতনা কর্মী পুষেছে, তারচেয়ে বেশি পুষেছে মাস্ল ম্যান। তাই দেখা যায় যে বিরোধী দলকে দমনের জন্য পুলিশের সাথে নেমে পড়ে হেলমেট বাহিনী। বলাবাহুল্য, এই হেলমেট বাহিনী হলো আওয়ামী লীগের স্টর্ম ট্রুপার বা ঝটিকা বাহিনী। যেমন ঝটিকা বাহিনী পুষতেন জার্মান ডিক্টেটর হিটলার।

আওয়ামী লীগ আজ সম্পূর্ণভাবে জনসমর্থন বর্জিত। সেই জনসমর্থন হীনতা ২০১২ সালেই প্রকট হয়েছে। তারপরেও গত ১০ বছর তারা দাপটের সাথে টিকে আছে। ক্ষমতায় থাকতে গেলে তাদের আর জনগণের কোনো প্রয়োজন নাই। তাদের প্রয়োজন পেশি শক্তি। সেটি সরকারি হোক, আর দলীয় হোক। এই শক্তি তাদের প্রচুর পরিমাণে আছে।

এখন বিএনপি যদি এই সরকারকে অপসারণ করতে চায় তাহলে তাদেরকে সরকারি এবং দলীয় পেশি শক্তির মোকাবেলা করতে হবে। এবং মোকাবেলা করতে হবে এফেক্টিভলি। এখানেই আসে এক পা এগিয়ে দু পা পিছিয়ে আসার কথা। গত ১ বছর থেকে বিএনপি বলছে যে বৃহত্তর ঐক্য করে তারা চূড়ান্ত আন্দোলনে নামবেন। আমি এখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে হাজার হাজার তথা লক্ষ লোক যদি রাস্তায় নেমে পড়েন তাহলে সরকারি বা দলীয় ঝটিকা বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হবে। কারণ জনতার শক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি। জনগণকে সেভাবে রাাস্তায় নামাতে হলে আপোষহীন কঠোর কর্মসূচি দিতে হবে। কিন্তু সেই সংগ্রামী জনতাকে কারা রাস্তায় নামাবে?

পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী বিএনপি এপর্যন্ত ৫৪ টি দলের সাথে সংলাপ করেছে। ২১ জানুয়ারি শনিবার আরো ৭ টি বাম দল একটি জোট করেছে এবং বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে আসার ওয়াদা করেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ৬১ টি দল বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে আসবে।
কিন্তু সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হলো এই যে, এই ৬১ টি দল কি ৩ হাজার লোককেও রাস্তায় নামাতে পারবে? একটি বাংলা সহযোগী একদিন এসব দলকে বলেছে খুচরা দল। আরেক দিন বলেছে অখ্যাত সব দল। আরেক দিন বলেছে প্যাড সর্বস্ব দল। আমি কারো প্রতি কোনো কটাক্ষ করছি না। যারাই রাজনীতি করেন তাদেরকেই আমি সম্মান করি। কিন্তু এত এত দলের সাথে সংলাপ হলো, কিন্তু দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ হলো না কেন? কেন তাদেরকে যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে রাখা হলো? গণমিছিলের দিনেই তো প্রমাণ হয়ে গেছে যে বিএনপির পরে কেউ যদি বৃহত্তম মিছিল বা মিটিং করতে পারে তাহলে সেটি হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এদেরকে বাইরে রেখে বিএনপি কি আন্দোলনে সফল হবে?

এসব প্রশ্ন আজ অনেকেই করছেন। গণঅবস্থান কর্মসূচিতে জামায়াত কেন অংশ নেয়নি সেটিও আজ বুঝতে হবে। জামায়াতের আমীর জেলে। তাদের সাধারণ সম্পাদক জেলে। এছাড়া যুগ্ম মহাসচিব সহ এখনও কয়েক হাজার নেতাকর্মী জেলে। সেদিন গণমিছিল থেকেও জামায়াতের আড়াই শাতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপির অনেকেরই জামিন হয়েছে। কিন্তু জামায়াতের নেতাকর্মীদের জামিন হয়নি। জামায়াতের ওপর আওয়ামী লীগ সরকার সার্বক্ষণিকভাবে খড়গ হস্ত। জামায়াতের এই মহা দুর্যোগের সময় তারা তাদের বড় বা ছোট সমমনাদের কোনো সহানুভূতি কি আশা করতে পারে না? তাদের পক্ষে কি একটি দুটি বিবৃতিও ইসু করা যেত না?

শেষ করার আগে একটি খবর দিতে চাই। পবিত্র ঈদুল ফিতর পালিত হবে ২২ বা ২৩ এপ্রিল। এখনও ৩ মাস বাকি। তারপর ঈদের রেশ আরো এক মাস। এর পরে নাকি তারা বড় কর্মসূচি দেবে। এ পর্যন্ত বিএনপি বড় কোনো প্রোগ্রামে যাচ্ছে না। এই বড় প্রোগ্রামকে ডেইলি স্টার বলেছে, ‘ফাইনাল পুশ’। এভাবে সময় নিয়ে কি দুর্বার আন্দোলন হয়? যারা রাজপথের আন্দোলন করেছেন তারা জানেন, আন্দোলনে ‘মোমেন্টাম’ বলে একটা কথা আছে। মোমেন্টাম ফুরিয়ে গেলে সেটিকে পুনরুদ্ধার করতে অনেক বেগ পেতে হয়। গত ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত জনগণের প্রবল মোমেন্টাম ছিল। সেটি কিন্তু ধীরে ধীরে ক্ষয় প্রাপ্ত হচ্ছে।
আমরা দেখেছি প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগ যে আন্দোলন শুরু করেছিল সেই আন্দোলন অবশেষে বিএনপির ক্ষমতাচ্যুতিতে পর্যবসিত হয়। আর এখন তো অর্থনৈতিক, রাজনেতিক এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিএনপি তথা বিরোধী দল সমূহের সম্পূর্ণ অনুকূলে।
তারপরেও এক পা এগিয়ে দুই পা পিছু হটা কেন?

https://dailysangram.com/post/515015