২৮ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ৭:০৫

উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ তবু আমদানি হচ্ছে

এখন আন্তর্জাতিক মানের টাইলস, টেবিলওয়্যার, স্যানিটারিওয়্যারসহ সব ধরনের সিরামিকপণ্য তৈরি করছে বাংলাদেশের ৭০টি কম্পানি। তাদের উৎপাদিত সিরামিকপণ্য এখন দেশের চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। তার পরও চাহিদার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সিরামিকপণ্য চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এতে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়সহ দেশীয় শিল্প বিকাশের স্বার্থে এখনই সিরামিকপণ্য আমদানি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।

সিরামিক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, বর্তমানে সিরামিকপণ্য আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই, তার পরও চীন থেকে নিম্নমানের সিরামিকপণ্য আমদানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সিরামিকপণ্যের বাজার দখলে নিতে চীনের বিভিন্ন কম্পানি ‘অ্যান্টিডাম্পিং’ করছে। তাদের দেশের স্বাভাবিক দামের চেয়ে অনেক কম দামে পণ্য বিক্রি করছে, যাতে তারা বাংলাদেশের সিরামিকের বাজারটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। তাই সরকারকে দেশীয় শিল্প বিকাশে আমদানি নিরুৎসাহ করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে বর্তমানে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যও আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছে না; যার কারণে এসব পণ্য আমদানি নিরুৎসাহ করা উচিত। কোনো কম্পানি এ দেশে ডাম্পিং করছে কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত।

বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) তথ্য মতে, এক যুগ আগেও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো বিভিন্ন ধরনের সিরামিকপণ্য। এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত সিরামিকপণ্য দেশের বাজারের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ৭০টি প্রতিষ্ঠান সিরামিকপণ্য বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করছে। এর মধ্যে ৩২টি প্রতিষ্ঠান টাইলস উৎপাদন করছে। ২০টি প্রতিষ্ঠান টেবিলওয়্যার (তৈজসপত্র) এবং ১৮টি প্রতিষ্ঠান স্যানিটারিওয়্যার উৎপাদন করছে। সিরামিক খাতে বিনিয়োগ ১৫ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় বাজারে এখন বছরে আট হাজার কোটি টাকার সিরামিকপণ্য বিক্রি করা হয়। বছরে এখন রপ্তানিও হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি সিরামিকপণ্য। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৮০০ কোটি টাকা।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে উৎপাদিত সিরামিকপণ্যের গুণগত মান ভালো হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ইউরোপসহ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। সরকার সিরামিকপণ্য রপ্তানিতে আরো সুনজর দিলে রপ্তানি বাড়বে। দেশের অর্থনীতিতে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে এই খাত।

এ ব্যাপারে বিসিএমইএর সভাপতি ও চায়না বাংলা সিরামিকের (সিবিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, “দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ চাহিদাই পূরণ করে বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে সিরামিকপণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে। তার পরও বছরে বিপুল পরিমাণ সিরামিকপণ্য আমদানি করা হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে। দেশের সিরামিকের বাজার দখলে নেওয়ার জন্য চীন ‘অ্যান্টিডাম্পিং’ পলিসি বস্তবায়ন করেছে, যার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে নিম্নমানের সিরামিকপণ্য রপ্তানি করছে। এগুলো এখনই বন্ধ করা উচিত। তা না হলে দেশীয় শিল্পের বড় ক্ষতি হতে পারে।” তিনি আরো বলেন, ‘যেসব সিরামিকপণ্য আমদানি করে আনা হচ্ছে, সেসব পণ্যের তুলনায় আমাদের পণ্যের গুণগত মান অনেক ভালো। তার পরও সিরামিকপণ্য আমদানি করে দেশে ডলার সংকটে চাপ বাড়ানো হচ্ছে। তাই যেকোনো অবস্থায় সব ধরনের সিরামিকপণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে।’

বিসিএমইএর তথ্য মতে, দেশে আবাসনশিল্পের বিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে সিরামিকের বাজার। সাশ্রয়ী মূল্য ও টেকসই হওয়ায় নির্মাণ, গৃহস্থালি ও শোভাবর্ধনকাজে সিরামিকের পণ্যসামগ্রীর ব্যবহার বহুগুণ বাড়ছে। এই শিল্পে এখন দেশের শীর্ষস্থানীয় গ্রুপগুলো বিনিয়োগ করছে। সম্ভাবনাময় এই খাত উদ্যোক্তাদের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছে, যার ফলে ছোট এই খাত দ্রুত সময়ের মধ্যে বৃহৎ একটি শিল্পে পরিণত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে সিরামিক খাতে শীর্ষে রয়েছে আকিজ সিরামিক, আরকে সিরামিক, গ্রেটওয়াল সিরামিক, সিবিসি, ফার সিরামিকস, এক্স, শেলটেক, ডিবিএল ও স্টার।

ফার সিরামিকসের পরিচালক ও বিসিএমইএর সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, যেহেতু ডলার সংকট চলছে, তাই সিরামিকপণ্য আমদানির বিষয়টি নিরুৎসাহ করতে সরকারকে এখনই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সিরামিকপণ্য আমদানি বন্ধ হলে সেটি বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ বাড়াতে যেমন সহায়ক হবে, তেমনি দেশীয় শিল্পেরও উন্নতি হবে। ইরফান উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের সিরামিকপণ্যের গুণগত মান বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভালো; যার কারণে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশেই আমাদের পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। গত ১০ বছরেই সিরামিক খাতে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে।’

জানতে চাইলে সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যদি বিদেশি কম্পানিগুলো সিরামিকের বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে অ্যান্টিডাম্পিং করে থাকে, তাহলে দেশীয় কম্পানিগুলোর উচিত এখনই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযোগ দাখিল করা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের এই কম্পানিগুলোর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আনবে। প্রমাণ পেলে সেসব কম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কারণ এটা একটি লিগ্যাল প্র্যাকটিস, যে কেউ এটা করতে পারে।’

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বর্তমান ডলার সংকট পরিস্থিতিতে সিরামিকপণ্য আমদানি নিরুৎসাহ করা উচিত। তবে সব সিরামিকপণ্যের উৎপাদনে সমানভাবে এখনো দক্ষতা গড়ে ওঠেনি। আমাদের দেশে তিন ধরনের সিরামিকপণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে, তার মধ্যে দক্ষতাটি মূলত টাইলসে রয়েছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণেও এটির সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু টেবিলওয়্যার ও স্যানিটারিওয়্যারের ক্ষেত্রে ভালো করলেও অভ্যন্তরীণ যে চাহিদা, সেটা মেটাতে দেশীয় কম্পানি সক্ষম নয়; যার কারণে সিরামিকের মধ্যে এ দুটি পণ্য এখনো বেশি আমদানি করতে হয়। তাই আমদানি বন্ধ করতে হলে টাইলসের মতো টেবিলওয়্যার ও স্যানিটারিওয়্যারের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে।’

দেশের সিরামিকপণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার রাজধানী ঢাকার বাংলামোটর। এখানের সিরামিকপণ্যের শোরুমগুলো ঘুরে দেখা গেছে, দেশীয় ব্র্যান্ডের সিরামিকের পণ্যের পাশাপাশি বিদেশি ব্র্যান্ডেরও সিরামিকপণ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, বিদেশি ব্র্যান্ডের টাইলস ও স্যানিটারিপণ্যের চেয়ে গুণগত মানের দিক দিয়ে অনেক ভালো দেশীয় ব্র্যান্ডের পণ্য। তাই এখন দেশি সিরামিকের পণ্যই বিক্রি হচ্ছে বেশি। বাংলামোটরের দেশি সিরামিকপণ্যের প্রতিষ্ঠান চায়না বাংলা সিরামিকের (সিবিসি) শোরুমের বিক্রয়কর্মী নিবিড় কালের কণ্ঠকে বলেন, বিদেশি সিরামিকের চেয়ে গুণগত মানের দিক দিয়ে ভালো হওয়ায় দেশি ব্র্যান্ডের সিরামিকপণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সিবিসি চীনের চেয়েও ভালো মানের টাইলস তৈরি করছে, দামের দিক দিয়েও সাশ্রয়ী।

বাংলামোটরে চীনা টাইলস বিক্রি করে ক্লাসিক টাইলস সেন্টার। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার মো. রিপন কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশীয় সিরামিকপণ্যের পাশাপাশি আমদানি করা সিরামিকের চাহিদাও ব্যাপক রয়েছে। তবে ডলার সংকটে এলসি জটিলতায় সিরামিকপণ্য আমদানি আগের চেয়ে কমে গেছে।

 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/28/1237956