২৮ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ৭:০৩

দুর্ভোগের সঙ্গে ব্যয়ও বেড়েছে

ক্যান্সার চিকিৎসায় রোগীদের দুর্ভোগ ও ব্যয় বেড়েছে। সারা দেশে মোট ৯টি সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি রেডিওথেরাপির ১৭টি যন্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে ১১টিই অকেজো। এতে বেশির ভাগ রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে বিপুল ব্যয়ে এই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। অনেক দরিদ্র রোগীর পক্ষে এই ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।

চিকিৎসকরা বলছেন, প্রাণঘাতী এই রোগের চিকিৎসায় প্রায় ৮০ শতাংশ রোগীর রেডিওথেরাপির দরকার হয়। দেশের সরকারি ৯টি হাসপাতালে এই সুবিধা থাকলেও বেশির ভাগ যন্ত্র নষ্ট। এ ছাড়া রয়েছে লোকবল সংকট। এতে রোগীদের বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হচ্ছে, যেখানে চিকিৎসায় ব্যয় বেড়েছে বহু গুণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বছরে ৬ থেকে ১০ লাখ টাকা।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দেশে ক্যান্সার রোগীদের রেডিওথেরাপি দেওয়া হয় মূলত দুই ধরনের মেশিনে। একটি কোবাল্ট মেশিন, অন্যটি লিনিয়ার মেশিন। সরকারি হাসপাতালে নতুন কোবাল্টে দিনে ২০০ জন রোগীর থেরাপি দেওয়া যায়। লিনিয়ার মেশিনে দিনে থেরাপি দেওয়া যায় ১০০ জনকে। সরকারি হাসপাতালে কোবাল্ট মেশিনে রেডিওথেরাপির জনপ্রতি খরচ ১০০ টাকা। এর সঙ্গে জনপ্রতি প্ল্যানিং খরচ এক হাজার ৫০০ টাকা। লিনিয়ার মেশিনে খরচ হয় ২০০ টাকা। এর সঙ্গে প্ল্যানিং খরচ এক হাজার ৫০০ টাকা।

অন্যদিকে শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ক্যান্সার হাসপাতালে লিনিয়ার মেশিনে বর্তমানে জনপ্রতি রেডিওথেরাপির খরচ সাড়ে চার হাজার থেকে আট হাজার টাকা। এর সঙ্গে প্ল্যানিং খরচ ৫১ হাজার ৫০০ থেকে ৭৯ হাজার টাকা। নাম না প্রকাশ করার শর্তে ওই হাসপাতালের এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানান।

জানা গেছে, বর্তমানে ক্যান্সারের চিকিৎসা চলা ৯টি সরকারি হাসপাতালের মধ্যে যেসব হাসপাতালে একটি করে মোট ছয়টি রেডিওথেরাপি যন্ত্র সচল রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

অকেজো ১১টি রেডিওথেরাপি যন্ত্রের মধ্যে ক্যান্সার হাসপাতালেই রয়েছে ছয়টি। এ ছাড়া ঢাকা মেডিক্যালে দুটি, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও রংপুর মেডিক্যালে একটি করে অকেজো যন্ত্র রয়েছে।

বাংলাদেশে সোসাইটি অব রেডিয়েশন অনকোলজিস্টসের (বিএসআরও) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রতি লাখ মানুষের জন্য অন্তত একটি রেডিওথেরাপি মেশিন দরকার। সে হিসাবে আমাদের ন্যূনতম ১৬০টি থেকে ১৮০টি রেডিওথেরাপি মেশিনের প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসকের সংখ্যাও বেশ অপ্রতুল। সারা দেশে অনকোলজিস্টের সংখ্যা সাকল্যে ২৮০ জনের মতো। আমাদের দরকার কম করে হলেও দেড় হাজার।’

দেশে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা : দেশে ক্যান্সার নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ক্যান্সার সম্পর্কিত অনলাইন ডাটাবেইস গ্লোবাক্যানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে দেড় লাখ মানুষ। মারা যায় প্রায় এক লাখ।

চলতি জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ওই হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়া ৮৩ হাজার ৭৯৫ জনের মধ্যে ৩৫ হাজার ৭৩৩ জনের (৪২.৬%) চূড়ান্ত কিংবা প্রাথমিকভাবে ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে। নিবন্ধিত রোগীর মধ্যে মোট ১৯ হাজার ৫৪৬ জন (৫৫%) পুরুষ এবং ১৬ হাজার ১৮৭ জন (৪৫%) নারী। পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ফুসফুসের ক্যান্সারে (২৬.৬%) এবং নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত স্তনের ক্যান্সারে (২৯.৩%)। নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রথম ১০টি ক্যান্সারের মধ্যে রয়েছে ফুসফুস (১৭.৪%), স্তন (১৩.৪%), জরায়ুমুখ (১০.৯%), খাদ্যনালি (৪.৯%), পাকস্থলী (৪.৩%), লিভার (৩.৯%), লসিকা গ্রন্থি (৩.৮%), মলাশয় (৩.১%), গাল (৩%) ও পিত্তথলি (১.৫%)।

জাতীয় ক্যান্সার ইপিডেমিওলোজি বিভাগের বিদায়ি অধ্যাপক মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, ‘পুরুষদের ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধান কারণ হলো ধূমপান। দ্বিতীয় কারণ বাড়িঘরে রান্নাবান্নার ধোঁয়া। তৃতীয় কারণ বায়ুদূষণ ও কারখানার ধোঁয়া। এ ছাড়া ভুল চিকিৎসার কারণে একজন নারীর স্তন ক্যান্সার ১০ বছর পর ফুসফুসের ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। আমরা বিভিন্ন সময় এক্স-রে করি। সেটি যদি বেশি বেশি করা হয়, সেখান থেকেও ক্যান্সার হতে পারে।’

অধ্যাপক মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, ‘নারীদের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্তনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে, অন্য কোনো সমস্যা থাক আর না থাক। পশ্চিমা দেশগুলোতে এই ঝুঁকি দেখা যায় ৫০ বছর পর, আমাদের এখানে ৩৫ বছর পর। এর পেছনে কিছু কারণ রয়েছে, যা নিয়ে গবেষণা দরকার।’

ক্যান্সার রোগীদের দুর্ভোগ : গত মঙ্গলবার সকাল ১০টা। রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগের প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকতেই দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। টিকিট কাউন্টারের সামনের এ চিত্র প্রতিদিন সকালের। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত হয়ে অনেকে বসে পড়েছেন মেঝেতে। গুরুতর রোগীদের কেউ আবার শুয়ে আছেন পাটি বিছিয়ে।

শুয়ে থাকা রোগীদের একজন রিতা আক্তার এসেছেন ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে। তাঁর চারপাশে ভন ভন করছে মাছি। রিতার বাবা মো. খুরশেদ বারবার মাছি তাড়াতে তাড়াতে হয়রান। খুরশেদ জানান, রিতা পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তিনি মেয়েলি কিছু সমস্যায় ভুগছিলেন।

খুরশেদ বলেন, ‘এইখানে আজকে দুই দিন। এখনো ভর্তি দেয় না। কয় বিছানা নাই। বাসা ভাড়া নিয়া তিনজনের থাকা। এর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অনেক খরচ! কী করব, গরিবের মরণ ছাড়া কোনো উপায় নাই।’

রিতার পাশেই মাদুরে বসে থাকা টাঙ্গাইলের রোকেয়া বলেন, ‘দুই বছর ধরে ক্যান্সারের চিকিৎসা করছি। জায়গা বিক্রি শেষ করে এখন শুধু ঘরটা আছে। প্রতিবার ভর্তির জন্য অপেক্ষা করে করে পাঁচ-ছয় দিন চলে যায়। বাসা ভাড়া করে থাকা আর পরীক্ষা করে কখনো এক লাখ, কখনো ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। কী করব, আর পারি না।’

রিতা ও রোকেয়ার মতো এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা বেশির রোগী এবং রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা প্রায় একই। তাঁরা জানান, বহির্বিভাগ থেকে টিকিট সংগ্রহের পর চিকিৎসকের কাছে পৌঁছা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করতে লেগে যায় প্রায় এক সপ্তাহ। আর চিকিৎসকদের দেওয়া এসব ব্যয়বহুল পরীক্ষাও করতে হয় বাইরের কোনো হাসপাতাল থেকে। কারণ এখানে ক্যান্সার রোগের পরীক্ষার বেশির ভাগ যন্ত্র নেই। যেগুলো আছে, বেশির ভাগই অকেজো।

রোগী ও স্বজনরা জানান, চিকিৎসক যখন ভর্তির পরামর্শ দেন, তখন আসল ভোগান্তির শুরু। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পেছনে ছুটতে ছুটতে হয়রান হতে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমরা আগের এক গবেষণায় দেখেছি, একজন ক্যান্সার রোগীর বছরে খরচ ৬ থেকে ১০ লাখ টাকা। এখন খরচ আরো বেড়েছে।’ এসব রোগীর চিকিৎসায় সরকারি একটি তহবিল গঠনে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

লোকবল ও যন্ত্র সংকট : জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে একাধিক সূত্রে জানা যায়, এখানকার রেডিওথেরাপির সাতটি যন্ত্রের মধ্যে ছয়টি তিন বছর ধরে অচল। একটি কোনো রকম চললেও দুপুর ১২টার পর বন্ধ থাকে লোকবল সংকটের কারণে। এ ছাড়া এখানে নেই এক্স-রে মেশিন, এমআরআই মেশিন। বিকেল ৪টার পর বন্ধ থাকে জরুরি রক্ত সঞ্চালন বিভাগ। অস্ত্রোপচার হয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসকের সংকট রয়েছে।

হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হক এই সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘১৫০ শয্যার লোকবল দিয়ে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল চালাতে হচ্ছে আমাদের। প্রতিদিন বহির্বিভাগেই চিকিৎসা নেয় দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ। ১০ জনের কাজ করতে হয় একজনকে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে অনেক মেশিন নেই, সেটা ঠিক। কিন্তু বাইরে থেকে যেসব পরীক্ষা রোগীরা করেন, সেগুলো ঢাকা মেডিক্যাল বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করাতে পারেন। সেটি কিন্তু রোগীরা করছেন না।’

অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হক বলেন, ‘আমাদের ৮টা অপারেশন থিয়েটার। প্রতিদিন ২০ জন রোগীর সার্জারি করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের অ্যানেসথেসিস্ট একজন। সিস্টার, ওটি বয়, ক্লিনার এসব নেই। এ কারণে সার্জারি চার থেকে ছয়টার বেশি করা যায় না। রক্ত সঞ্চালন বিভাগে আমাদের লোক মাত্র একজন। তিন বছর ধরে রেডিওথেরাপির মেশিন রক্ষণাবেক্ষণের লোক নেই।’

তিনি বলেন, এই হাসপাতালটিকে ৫০০ শয্যা বলা হচ্ছে, কিন্তু প্রস্তাবনা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়িত হলে চিকিৎসকরা আরো উদ্যমী হয়ে কাজ করতে পারবেন। একই সঙ্গে রোগীর সেবার মান অনেক বাড়ানো সম্ভব হবে।


https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/28/1237954