২৮ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ৭:০১

এক বছরে ঢাকার ৩ নদীতে ১০৯ লাশ

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে গত বছরের ৭ই নভেম্বর নিখোঁজ বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ফারদিন নূর পরশ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)’র সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের নয়ামাটি এলাকার কাজী নুর উদ্দিনের ছেলে। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে শিক্ষার্থী ও বুড়িগঙ্গা নদী থেকে এক আওয়ামী লীগ নেতার লাশ উদ্ধারের ঘটনা আলোচনায় ছিল দেশজুড়ে। ফারদিন নূর পরশ ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কৃষি উপ-কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দুরন্ত বিপ্লব হত্যার ধরন ছিল প্রায় একই। তাদের মধ্যে ফারদিনের মরদেহ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে এবং দুরন্ত বিপ্লবের মরদেহ বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তাদের দুজনকেই মাথায় ও বুকে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর দু’জনকেই নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। গত বছরের ১২ই নভেম্বর বিকালে বুড়িগঙ্গা নদীর পানগাঁও এলাকা থেকে দুরন্ত বিপ্লবের মরদেহ উদ্ধার করে পাগলা নৌ-পুলিশ।

এর এক মাসেরও বেশি সময় পরে ডিএমপি’র গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন-অর-রশিদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া এবং অর্থাভাবের মতো নানা কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ফারদিন আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। তাকে হত্যা করা হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি।

অজ্ঞাত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা প্রায় ২০ বছর আগে নব্বই দশকের আলোচিত মডেল ও অভিনেত্রী সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নির হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে। কিন্তু তিন্নি হত্যা মামলার বিচার এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। গ্রেপ্তার হয়নি তার একমাত্র খুনি তৎকালীন এক সংসদ সদস্যসহ অন্যরা। ২০০২ সালের ১০ই নভেম্বর রাতে কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা নদীর ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ১১ নম্বর পিলারের পাশে তার লাশ পড়েছিল। তিন্নি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে ৪১ জনকে সাক্ষী করা হয়। এ ছাড়াও এই মামলায় ২২টি আলামত জব্দ করা হয়। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ৮ই নভেম্বর সাবেক ছাত্রনেতা ও সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে একমাত্র আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর গ্রিনরোড এলাকার বাসায় থাকতেন ৪০ বছর বয়সী চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শিমু। গত বছরের ১৬ই জানুয়ারি বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। ১৭ই জানুয়ারি তার সন্ধানে পরদিন কলাবাগান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন স্বামী নোবেল। সেদিন দুপুরে স্থানীয়দের কাছে খবর পেয়ে কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ব্রিজের কাছে আলিয়াপুর এলাকায় রাস্তার পাশে বস্তা থেকে এক নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। রাতে ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে গিয়ে ওই লাশ শিমুর বলে শনাক্ত করেন তার বড় ভাই শহীদুল ইসলাম খোকন। মামলা হওয়ার পর ওই রাতেই স্বামী নোবেল ও তার বাল্যবন্ধু ফরহাদকে আটক করে কেরাণীগঞ্জ মডেল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পারিবারিক বিষয়াদি ও দাম্পত্য কলহের কারণে শিমুকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করেছে শিমুর স্বামী নোবেল ও লাশটি গুম করতে সহায়তা করেছে নোবেলের বন্ধু ফরহাদ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানী ও তার আশপাশের নদীগুলোতে গড়ে প্রতি ৪ থেকে ৭ দিনে মিলছে ১টি করে মরদেহ। যার অধিকাংশই বেওয়ারিশ। গত এক বছরে রাজধানীর বালুনদী, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ নদী থেকে প্রায় ১০৯টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যার অধিকাংশই বেওয়ারিশ। মরদেহ পানিতে থাকায় পচেগলে বিকৃত হয়ে যায়। ফলে হাতের ফিঙ্গারপ্রিন্টের রেখাগুলো বিকৃত হওয়ায় অজ্ঞাত মরদেহের প্রকৃত পরিচয় খুঁজে বের করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। তথ্য প্রমাণের অভাবে নাগালের বাইরে থেকে যায় প্রকৃত অপরাধী। ডিএমপি’র নৌপুলিশ, সরকারি হাসপাতাল, একাধিক থানা সূত্র জানায়, ২০২২ সালে পুরো বছরজুড়ে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী থেকে ৫০টি মরদেহ, শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ২০টি, বালুনদীসহ পাশর্^বর্তী নদী থেকে ২৫টি এবং তুরাগ থেকে ১৪টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে জনকল্যাণমূখী সংস্থা আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম গত বছরের প্রথম ৯ মাসে প্রায় তিনগুণ বেওয়ারিশ লাশ দাফনের কথা জানিয়েছে। সংস্থাটির সূত্র জানায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৯ মাসে রাজধানীর জুরাইন এবং রায়েরবাজার কবরস্থানে মোট ৩৩৮টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। এরমধ্যে ২৭২টি মরদেহ জুরাইন কবরস্থানে এবং ৫৫টি রায়েরবাজারে।

এ বিষয়ে ঢাকা জেলা নৌপুলিশ এর পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস মানবজমিনকে বলেন, চলতি মাসে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী দুই যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে একটি বালু নদীর রাজাখালী এলাকা থেকে অপরটি পোস্তগোলার হাসনাবাদ এলাকা থেকে। অধিকাংশ লাশ পানিতে থাকায় পঁচে বিকৃত হয়ে যায়। ফলে লাশের হাতের ফিঙ্গার প্রিন্ট এর মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করা খুবই কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। এসব ক্ষেত্রে লাশের ছবি তুলে, পোস্টারিং করে, ডিএমপি’র থানাগুলোতে ম্যাসেজ পাঠিয়ে, গণমাধ্যমের সহায়তায় লাশের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হয়। এই পুলিশ সুপার বলেন, ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর এর পক্ষ থেকে বিশেষ নির্দেশনায় নদীকেন্দ্রিক এই অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে সেখানে পর্যাপ্ত লাইটিং এবং সিসিটিভি ভিডিও ক্যামেরার আওতায় আনার জন্য পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন। পর্যাপ্ত জলজান এবং জনবলের বিষয়ে ইতিমধ্যে সদরদপ্তরকে জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, লোভ-লালসা, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য এবং আক্রোশ থেকে সাধারণত এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নদী এবং জলাশয়কে অপরাধীরা মরদেহ ফেলা বা গুম এর জন্য নিরাপদ স্থান বলে মনে করে। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন পর মরদেহ উদ্ধার এবং শনাক্ত হলে ততদিনে লাশের সুরতহাল-আলামত নষ্ট হয়ে যায়।

ফলে অপরাধীদের চিহ্নিত শেষে গ্রেপ্তার করা কঠিন হয়ে পড়ে। ক্ষেত্র বিশেষে অপরাধীরা ধরা পড়লেও বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং বিচারের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে অপরাধীরা এই পদ্ধতিটিকেই বেছে নেয়। এতে করে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় খুব সহজেই পার পাওয়া সম্ভব। তিনি বলেন, এই ধরনের অপরাধ প্রবণতা কমাতে হলে সর্বপ্রথম নদী ও জলাশয়ভিক্তিক এ ধরনের অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এসব স্থানে পুলিশি নজরদারি, টহল, সিসিটিভি ভিডিও ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও বৃদ্ধি না করা হলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড এবং অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

https://mzamin.com/news.php?news=40342