২৮ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ৬:৪১

রাতে ফ্লাইওভারে অপরাধীরা ভয়ঙ্কর

রাজধানীর ফ্লাইওভারগুলো রাত হলেই অরক্ষিত হয়ে পড়ে। রাত যত বাড়ে ফ্লাইওভারে অপরাধী চক্রের আনাগোনাও তত বাড়ে। ছিনতাইকারী, ডাকাত ও মাদকসেবীসহ অপরাধী চক্রের অভয়ারণ্যে রূপ নেয় ফ্লাইওভার। রাতে ফ্লাইওভার ব্যবহার করে চলাচল করা যাত্রীরা টার্গেটে পরিণত হন। বিভিন্ন কৌশলে অপরাধীরা সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে টাকা ও মালামাল কেড়ে নেয়। ফ্লাইওভারে বাতি না জ্বলা এবং গভীর রাতের নির্জন পরিবেশ বিরাজ করায় ছিনতাইয়ের নিরাপদ জায়গা হিসেবে বেছে নিচ্ছে। এ কাজে বেশিরভাগ সময় ভিকটিম হচ্ছেন মোটরসাইকেল চালক, সিএনজি অটোরিকশার যাত্রী এবং পথচারীরা।

ফ্লাইওভারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে মাক্রোবাস, প্রাইভেটকার ও মোটারসাইকেল থামিয়ে যাত্রীদের মারধর করে টাকা ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। শুধু ফ্লাইওভারের উপরেই নয়, ফ্লাইওভারের নিচেও নির্জন স্থানে লোকজনকে টার্গেট করে অপরাধীরা। সাধারণত রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিলেঢালা তৎপরতায় এ সুযোগ নেয় অপরাধীরা। সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে মহাখালী ফ্লাইওভারে ছিনতাইয়ের সময় এক র‌্যাব সদস্যসহ চার জনকে গ্রেফতার করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সন্ধ্যার পর থেকে রাত যত গভীর হয় ফ্লাইওভারগুলো তত ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে রাজধানীর মহাখালী, কুড়িল বিশ^রোড, বনানী ও মালিবাগ-মগবাজার এলাকার ফ্লাইওভারে সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত যানজট লেগে যায়। এ সময় ছিনতাইকারীরা নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করে অন্যরা কিছু বোঝার আগেই সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। শুধু যানজট নয়, ফাঁকা ফ্লাইওভার আরো ভয়ঙ্কর। অপরাধী চক্র ফ্লাইওভারের দুপাশে নাইলনের সুতা ধরে রাখে। এ সময় মোটরসাইকেল আরোহীরা ওই পথ দিয়ে গেলে সুতা গলায় বেঁধে পড়ে যান। তখন কৌশলে সব টাকা পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায় চক্রটি। অভিযোগ রয়েছে- মালিবাগ, হাতিরঝিল, মহাখালী, মগবাজার ফ্লাইওভারে মাসে অর্ধশতাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। এছাড়া যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে ছিনতাইয়ের পাশাপাশি ডাকাতির ঘটনাও ঘটছে।

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইওভারের ল্যাম্পপোস্টগুলোতে রাতে লাইট জ্বলে না। ফ্লাইওভারগুলোতে নেই সিসি ক্যামেরা। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুৎ খুঁটির গোড়া থেকে চোরেরা বৈদ্যুতিক তার কেটে নিয়ে যাওয়ায় রাতে অন্ধকারে ডুবে থাকে ফ্লাইওভারটি। অপরাধী ও ছিনতাইকারীদের ভয়ে রাতে ফ্লাইওভার ব্যবহারকারী প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল আরোহীরা যখন-তখন বিপদে পড়ছেন। মাদকসেবীদের আস্তানা হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে কোনো কোনো ফ্লাইওভার। বেশির ভাগ ফ্লাইওভারের নিচে ভোরবেলা ও সন্ধ্যায় চলে মাদক সেবন ও বিক্রি। আর সন্ধ্যার পর শুরু হয় ছিনতাইকারীদের উৎপাত। ফ্লাইওভারের ওপর তারা গাড়ি পার্ক করে ছিনতাইয়ের জন্য অপেক্ষা করে। ফ্লাইওভার ব্যবহার করে নিয়মিত যাতায়াত করা অনেক যাত্রী জানান, মগবাজার, তেজগাঁও এবং চৌধুরীপাড়া মালিবাগ-শান্তিনগর-রাজারবাগ ফ্লাইওভারে কোন সড়ক বাতি নেই। রাতে সড়ক বাতি না জ্বলায় গভীর রাতে এসব ফ্লাইওভারে তৈরি হয় অন্যরকম পরিবেশ। অন্ধকার থাকায় রাতে দুর্ঘটনা বেশি হয়। চুরি-ছিনতাই হয় প্রতিনিয়ত এবং মাদক ব্যবসা আর সেবনের জন্যে পরিণত হয় নির্ভয় জায়গায়।

যাত্রীরা অভিযোগ করে জানান, রাতের বেলায় এসব ফ্লাইওভারে টহল পুলিশও দেখা যায় না এবং নজরদারি নেই বললেই চলে। একটু বৃষ্টি হলেই মহাখালী ও মিরপুর ফ্লাইওভারের মুখে হাঁটু পানি জমে থাকে। মহাখালী ফ্লাইওভারের উঠা-নামার মুখগুলোতে যাত্রীবাহী বাসগুলো থামিয়ে যাত্রী উঠা-নামা করার কারণন সৃষ্টি হয় যানজট। কুড়িল বিশ^রোড ফ্লাইওভার এলাকায় নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট জানান, আমাদের এখানে এখনো ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিদিন যে লোকবল দেওয়া হয় সেগুলো রাস্তার হিসেবে দেওয়া হয়। ফ্লাইওভারগুলোতে ট্র্যাফিক দেখভালের জন্য আলাদা করে কোন লোকবল দেওয়া হয় না। তাই সেগুলো ট্র্যাফিক নজরদারিতে থাকে না। মূলত ফ্লাইওভারগুলোতে নজরদারি রাখতে যে লোকবল ট্র্যাফিক সেক্টরে দরকার তত লোকবল আমাদের নেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী মহাখালী, মৌচাক ও যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে মাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তবে বেশিরভাগ ভুক্তভোগি থানায় অভিযোগ করেন না।

জানা গেছে, গত শুক্রবার (২০ জানুয়ারি) গভীর রাতে রাজধানীর মহাখালী ফ্লাইওভারে গাড়ি থামিয়ে ছিনতাই চেষ্টার অভিযোগে এক র‌্যাব সদস্যসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে বনানী থানা পুলিশ। এ ঘটনায় শনিবার আল মোমেন নামে এক র‌্যাব সদস্যসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী শহীদুল ইসলাম। গ্রেপ্তার অন্য আসামীরা হলো- আরিয়ান আহমেদ জয় ও ফরহাদ হোসেন। এ ছাড়া জালাল নামে এক আসামী পলাতক রয়েছেন। ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মামলার বাদী শহীদুল ইসলাম বলেন, তার ভাগ্নে রিয়াজকে সঙ্গে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে একটি ভাড়া গাড়িতে তারা যাচ্ছিলেন। মহাখালী ফ্লাইওভারে তাদের গাড়িটি উঠলে ব্যারিকেট দিয়ে গাড়ি থামিয়ে জানালা দিয়ে পিস্তল ধরে। গাড়ি থেকে বের হওয়ার পর বলে- আমরা সোনা চোরাচালানকারী। আমরা বলি, আমাদের চেক করে দেখেন। তখন আমাদের মারধর শুরু করে। গুলী করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তারপর হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেয়। এ সময় আমরা চিৎকার শুরু করলে এক ব্যক্তি গাড়ি থামিয়ে ৯৯৯-এ কল করেন। তখন সে পথ দিয়ে মোটরসাইকেলে বাসায় ফিরছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাকিব নামে এক পুলিশ সদস্য, হট্টগোল দেখে তিনিও এগিয়ে আসেন। পরে জনতা একজনকে ধরে ফেলে, বাকিরা পালিয়ে যায়। পুলিশ অভিযান চালিয়ে র‌্যাব সদস্য আল মোমেনসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে।

https://dailysangram.com/post/514982