২৭ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ৬:১৭

ব্যাগেজের বিলাসী পণ্যে যাচ্ছে ডলার

কৃচ্ছ্রসাধননীতি ঘোষণার পরও ব্যাগেজ রুলসের অপব্যবহারে বিপুল অঙ্কের ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি নিয়ন্ত্রণ করা হলেও ব্যবসায়ীরা ব্যাগেজ রুলসের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে এসব পণ্য দেশে আনছেন। এতে চলে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ ডলার। এ অবস্থায় ব্যাগেজ রুলস নীতিমালা সংশোধন, পণ্য আনা সীমিতকরণ এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ব্যাগেজ রুলসে আকাশপথে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহ আমানত ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে পণ্য আসে। শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে বছরে প্রায় ৪০ লাখ আন্তর্জাতিক যাত্রী আসা-যাওয়া করে। একজন যাত্রী ৪০ কেজি পর্যন্ত মালপত্র শুল্ক ছাড়াই বহন করতে পারে। এই হিসাবে বছরে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার টন পণ্য বিনা শুল্কেই দেশে ঢুকছে, যার মধ্যে বেশির ভাগই বিলাসী পণ্য। যাত্রীরা সরকার নির্ধারিত শুল্ক দিয়ে চাইলে আরো বেশি পরিমাণ পণ্য নিয়ে আসতে পারে।

শাহ আমানত ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বছরে প্রায় ৩০ লাখ যাত্রী আসা-যাওয়া করে। যাত্রীপ্রতি ৪০ কেজি পর্যন্ত মালপত্র বিনা শুল্কে নিয়ে আসতে পারার হিসাবে চট্টগ্রাম ও সিলেট দিয়ে প্রতিবছর দেশে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন শুল্কমুক্ত বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য দেশে ঢুকছে।

দেশের ১৪টি স্থলবন্দর দিয়েও ভারত থেকে ঢুকছে অনেক শুল্কমুক্ত সুবিধার বিলাসী পণ্য। গত বছরের ১৮ অক্টোবর কলকাতা থেকে ঢাকায় (ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন) আসা মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে আকস্মিক অভিযান চালায় শুল্ক গোয়েন্দা। এ সময় বাংলাদেশ ও ভারতীয় পাসপোর্টধারী যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি করে দুই কোটি ৬৫ লাখ টাকার অবৈধ পণ্য আটক করা হয়, যার মধ্যে ৭৩১ পিস শাড়ি, দুই হাজার ২৬৫ পিস থ্রিপিস, ২১০ পিস শাল ও চাদর, ১১৪ পিস শার্ট, ৩৫ পিস টি-শার্ট, ২০৬ পিস ওড়না, ১৮১ পিস ট্রাউজার, ৫৯২ পিস আন্ডারগার্মেন্ট, ৯০ পিস ওয়ান পিস, ১৫ পিস ব্লেজার, ৩২ পিস পাঞ্জাবি ইত্যাদি ছিল।

এনবিআরের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে গত বছরের ১০ মাসে ভারত থেকে আসা পাসপোর্টধারী যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি করে ৩০ কোটি টাকার ভারতীয় অবৈধ পণ্য জব্দ করা হয়। বর্তমানে বিলাসী পণ্যের এলসি বন্ধ থাকায় এভাবে অবৈধ পণ্যের বাণিজ্য আরো বেড়েছে বলে মনে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

শুল্ক গোয়েন্দার একটি প্রতিবেদন সূত্র জানায়, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শুল্ক ফাঁকি ও চোরাই পথে আনা চার হাজার ১৮৭ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের পণ্য আটক করা হয়। এভাবে পণ্য আনার প্রবণতা আরো বেড়েছে।

ব্যাগেজ রুলস পরিবর্তন ও সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরও। সম্প্রতি সংস্থাটির দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ডলারের সংকট ও দাম বাড়ায় উদ্ভূত সমস্যার মধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স আশঙ্কাজনক হারে কমছে। বিশেষ করে সোনা আনার উৎসস্থল দেশগুলো থেকে বেশি কমছে রেমিট্যান্সের প্রবাহ। এ জন্য ব্যাগেজ রুলস সংশোধন করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।

এনবিআরের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় প্রদত্ত সুযোগ ব্যবহার করে প্রবাসীদের বৈদেশিক মুদ্রায় রেমিট্যান্সের বদলে সোনা ও অন্যান্য পণ্য নিয়ে আসা সম্প্রতি বেড়েছে। এতে তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে বেশি লাভবান হচ্ছেন। এ বিষয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণও জানায় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তর। সংস্থাটির পরিচালক স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ব্যাগেজ রুলস অনুযায়ী একজন যাত্রী বিদেশ থেকে দেশে আসার সময় ১০০ গ্রাম (সাড়ে আট ভরি) ওজনের স্বর্ণালংকার আনতে পারে, এ ক্ষেত্রে কোনো শুল্ক-কর দিতে হবে না। এ ছাড়া একজন যাত্রী ২৩৪ গ্রাম (২০ ভরি) ওজনের সোনার বার আনতে পারে, এ ক্ষেত্রে ভরিপ্রতি দুই হাজার টাকা করে শুল্ক দিতে হয়। অর্থাৎ সোনার বার আনলে ৪০ হাজার টাকা শুল্ক-কর দিতে হয়। কিন্তু ১০০ গ্রাম বা সাড়ে আট ভরির বেশি অলংকার আনার ক্ষেত্রে ব্যাগেজ রুলসে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। তাই অনেক যাত্রী শুল্ক-কর দিয়ে বাড়তি অলংকার সঙ্গে করে নিয়ে আসছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বিদেশ থেকে সোনাসহ বিলাসী পণ্য আনতে প্রবাসে কর্মরত একটি সংঘবদ্ধ চক্র বা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। দেশে ফেরত আসার সময় প্রবাসী শ্রমিকরা ক্যারিয়ার গ্রুপ হিসেবে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে পণ্য বহন করেন। অথবা সিন্ডিকেট প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার তুলনামূলক বেশি দামে কিনে নিয়ে ওই দেশেই পণ্যের দেনা পরিশোধ করে এবং বাড়তি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় পণ্য নিয়ে দেশে ফিরতে উৎসাহিত করছে।

প্রতিবেদনে রেমিট্যান্স কমার চিত্র দিয়ে বলা হয়, গত অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স আসা সবচেয়ে বেশি কমেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ২২.১৭ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৪০.৬৫ শতাংশ, কাতার থেকে ৫০.৭১ শতাংশ, কুয়েত থেকে ১৬ শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে। এসব দেশ থেকেই বেশি সোনা আসছে। একই সঙ্গে সিঙ্গাপুর থেকে ৪৩ শতাংশ রেমিট্যান্স এবং মালয়েশিয়া থেকে ৫৭ শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে। এই দুটি দেশ থেকেও সোনা আনার ঘটনা ধরা পড়ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। প্রতিবেদনে ব্যাগেজ রুলস সংশোধনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়।
কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ব্যাগেজ রুলসে একজন যাত্রী ব্যক্তিগত ব্যবহারের ক্রীড়া সরঞ্জাম, টাইপরাইটার, ঘরে ব্যবহারের সেলাই মেশিন, সিলিং ফ্যান, টেবিল ফ্যান, রাইস কুকার, প্রেশারকুকার, গ্যাস ওভেন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, টোস্টার, স্যান্ডউইচ মেকার, ব্লেন্ডার, ফুড প্রসেসর, জুসার, কফি মেকার, ১৫ বর্গমিটার আয়তন পর্যন্ত কার্পেট, দুটি মোবাইল ফোন সেট, ক্যাসেট প্লেয়ার, সিডি প্লেয়ার, বহনযোগ্য অডিও সিডি প্লেয়ার, ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ কম্পিউটার, একটি ইউপিএস, কম্পিউটার স্ক্যানার, প্রিন্টার, ফ্যাক্স মেশিন, ভিডিও ক্যামেরা (এইচডি ক্যমেরা, ডিভি ক্যামেরা, বেটা ক্যামেরা), ছবি তোলার ডিজিটাল ক্যামেরা, ১৯ ইঞ্চি পর্যন্ত এলসিডি কম্পিউটার মনিটর, ২৯ ইঞ্চি পর্যন্ত প্লাজমা, এলসিডি, এলইডি, সিআরটি টেলিভিশন, চারটি স্পিকারসহ সিডি, ভিসিডি, ডিভিডি

ইত্যাদি বিনা শুল্কে আনতে পারে। এ ছাড়া ১০০ গ্রাম স্বর্ণালংকার বিনা শুল্কে আনতে পারে।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমপিআইএ) সূত্র জানায়, বছরে দেশে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার মুঠোফোন অবৈধভাবে ঢুকছে, যার বেশির ভাগই আসে ব্যাগেজ রুলসের অপব্যবহার করে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সব ক্ষেত্রেই বিলাসী পণ্য পরিহার করতে হবে। এ তালিকায় ফলমূলসহ সব কিছু রাখতে হবে।’

তিনি বলেন, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় যাত্রীরা কী আনবে, সেটা সুস্পষ্ট ডিক্লেয়ার থাকতে হবে এবং সেখানেও কন্ট্রোল রাখতে হবে সরকারকে। কারণ ব্যাগেজ রুলসের অপব্যবহার সব সময় কিছু না কিছু হয়। যারা এটা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্যাগেজ রুলসে কেউ কোনো অপ্রয়োজনীয় জিনিস বা বিলাসী পণ্য আনছে কি না, সেটা যাচাই করতে হবে। এগুলো আমদানিতে নিরুৎসাহ করতে হবে। তবে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আনার সুযোগ থাকতে হবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/27/1237326