২৭ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ৫:৫৪

ছুটিতে আছেন ২৩ শতাংশ শিক্ষক

বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করেন অনেকে

দেশের ৪৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক আছেন ১৫ হাজার ৫ জন। তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৫২৮ জন অন্তত ৫ ধরনের ছুটিতে আছেন, যা মোট শিক্ষকের ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

অন্যদিকে এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন চাকরির প্রবণতাও আছে। এছাড়া কারও কারও বিরুদ্ধে এনজিও ব্যবসা, বিদেশি সংস্থায় পরামর্শকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করার অভিযোগও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

সূত্র বলছে, উল্লিখিত পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান শিক্ষক সংকট। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষকের অভাব বেশি। বিজ্ঞপ্তি দিয়েও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পাচ্ছে না। আবার কোথাও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে নিয়োগ করা হচ্ছে না শিক্ষক।

এমন পরিস্থিতিতে জুনিয়র শিক্ষক কিংবা যা আছে তা দিয়েই চলছে সেখানকার লেখাপড়া। মূলত ছুটি, পদশূন্যতা আর প্রতিষ্ঠানের বাইরে বিভিন্ন কাজে শিক্ষকরা জড়িয়ে পড়ায় গুণগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ছাত্রছাত্রীরা। ফলে সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান আর গবেষণা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেসব ছুটিতে যান বা ভোগ করেন, সেটা তার কোনো অধিকার নয়। বিভাগের প্রয়োজন থাকলে এবং কর্তৃপক্ষ চাইলে কাউকে ছুটি না দিলেও পারেন। বর্তমানে শিক্ষা ছুটির পাশাপাশি প্রেষণ, লিয়েন, বিনা বেতন এবং খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিক চাকরির জন্যও ছুটি দেওয়ার রেওয়াজ আছে।

এছাড়া একটানা ৬ বছর চাকরির পর বেতনসহ প্রায় ১ বছরের ‘সাববাটিক্যাল’ (বিশ্রামসম্পর্কিত) ছুটি নিতে পারেন। এই সময়ে ছুটি গ্রহণকারী গবেষণা কিংবা ভ্রমণ করতে পারবেন, কোনো চাকরি নয়। কিন্তু এই ছুটির অপব্যবহারের ঘটনা আছে।

কুয়েটের এই সাবেক উপাচার্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি আর নিয়োগ নিয়ে আসলেই ‘হযবরল’ অবস্থা আছে। প্রথমত, একজন শিক্ষক চাকরিতে যোগ দেওয়ার দুবছর পর শিক্ষা ছুটিতে যেতে পারেন। এখন তিনি যদি পিএইচডি করতে যান এবং ডিগ্রি শেষ করে আসতে পারেন, তাহলে তার নতুন জ্ঞান দেশের শিক্ষা ও গবেষণায় কাজে লাগানো যেতে পারে। এটা ইতিবাচক দিক।

কিন্তু পিএইচডি ডিগ্রিসহ শিক্ষক নিয়োগের বিধান করা গেলে কাউকে আর দীর্ঘ সময়ের জন্য এ ধরনের ছুটি দেওয়ার প্রয়োজন পরে না। সুতরাং নিয়োগবিধি পরিবর্তন করে ডক্টরেট ডিগ্রিসম্পন্নদের সরাসরি সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা যেতে পারে। আর এখন যারা প্রভাষকের কাজ করেন, তাদের স্থলে তখন পিএইচডি গবেষকদের মধ্য থেকে বেতন সুবিধায় ‘গ্রাজুয়েট অ্যাসিস্ট্যান্ট’ (জিটি) নিয়োগ করা যেতে পারে। এতে দেশে গবেষণার পরিবেশ ও প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।

পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নত হবে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটের যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা দূর করা সম্ভব হবে। তিনি শিক্ষকদের ছুটিতে কড়াকড়ি আরোপের প্রস্তাব রেখে বলেন, লিয়েন, প্রেষণ, খণ্ডকালীন আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ছুটি দিয়ে শিক্ষককে অন্যত্র কাজের সুযোগ দেওয়া মানে হলো নিজের ঘর অন্ধকারে রেখে অন্যের ঘরে আলো জ্বালানো।

দেশের বৃহত্তর স্বার্থে শিক্ষক নিয়োগ আর ছুটিবিধিতে আমূল পরিবর্তন আনা দরকার বলে মনে করেন তিনি। পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, বিনা বেতনের ছুটি কঠোর তদারকির মধ্যে আনা দরকার। আর যারা অননুমোদিত ছুটিতে আছেন, তাদের চাকরি পরিসমাপ্তির আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

গত ১৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে পেশ করা ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৪৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ হাজার ৫২৮ শিক্ষক অন্তত ৫ ধরনের ছুটিতে ছিলেন। এটা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ২০২১ সালের কার্যক্রমের ওপর পরিচালিত সমীক্ষার ফল।

এর আগের বছর এসব ছুটিতে ছিলেন ৩ হাজার ৫১১ শিক্ষক। অর্থাৎ, ছুটিতে যাওয়া শিক্ষকের সংখ্যা বেড়েছে। আগের বছরগুলোর তুলনায়ও এই সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। যেমন : ২০১৯ সালে ছুটিতে যাওয়ার মোট সংখ্যা ছিল ২২৬৪ জন আর ২০১৮ সালে ২১৩৩ জন।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ছুটিতে যাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে ২০৯২ জনই আছেন শিক্ষা ছুটিতে। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ২০৮৮ জন। উল্লিখিত বছরে (২০২০) প্রেষণ ও লিয়েন নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ৭৬ জন। ২০২১ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪ জন। ২০২১ সালে বিনা বেতনে ছুটিতে ছিলেন ৯২ জন।
তবে আগের বছর এটা ছিল ২০৩ জন। অন্যদিকে ২০২০ সালে ছুটি শেষ হওয়ার পরও অননুমোদিতভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন ৪৩ জন। ২০২১ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪ জনে। আর ২০২০ সালে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে চাকরি করেছেন ১২০১ জন। ২০২১ সালে এই সংখ্যা অবশ্য কমে দাঁড়িয়েছে ১১৯৬ জন।

খণ্ডকালীন চাকরিতে সবচেয়ে এগিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির ২৩১১ শিক্ষকের মধ্যে ২০২১ সালে ৪৫৪ জনই খণ্ডকালীন চাকরি করেছেন। এ ছুটি নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, যেখানে ২০৮ জন। আর তৃতীয় স্থানে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানকার ১২৩ জন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। শিক্ষা ছুটিতে সবচেয়ে বেশি আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, ৩২৯ জন।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে বুয়েট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এটা যথাক্রমে ১৬৪ ও ১২৬ জন। প্রেষণ বা লিয়েনে অন্যত্র চাকরি করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ জন। এটা ৪৭ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ আর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন। বিনা বেতনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ জন, জাহাঙ্গীরনগরের ২০ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ জন আছেন।

অননুমোদিত ছুটিতে শীর্ষে আছে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির ১৭ জন এ ধরনের ছুটিতে আছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোয় যথাক্রমে ১১ ও ৭ জন আছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি বা পরামর্শকসহ বিভিন্ন পদে বেশি কদর বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। যে কারণে তাদের অনেকের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ছুট মনোভাবও বেশি। এছাড়া পিএইচডি করতে গিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে অবস্থান করা শিক্ষকের সংখ্যাও কম নয়।

যেহেতু এ ধরনের ছুটির ক্ষেত্রে উদারতা আছে, তাই অনেকেই সুযোগটি নিয়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নীল-সাদা-হলুদ-গোলাপিসহ বিভিন্ন রঙের রাজনীতি আছে। তাই অনেকেই পার পেয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও হালনাগাদ তথ্য রাখে না। এছাড়া ইউজিসির মতো কেন্দ্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানেও এ ধরনের তথ্য নেই।

বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, এর বাইরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এনজিও ব্যবসা, বিদেশি সংস্থায় পরামর্শকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করছেন আরও ৫ শতাধিক। নিজের বিভাগে অনিয়মিত থেকে তারা উল্লিখিত পন্থায় অর্থ উপার্জন করছেন। অনেকে কোনো রকমে ক্লাস নিয়ে শেয়ারবাজারেও পড়ে থাকেন।

এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক্ষ্যাপ’ বাণিজ্য তো আছেই। খণ্ডকালীন চাকরির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিতে হয়। তবে এক্ষেত্রে আয়ের একটি অংশ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেওয়ার বিধান আছে। এ কারণে অনেকেই অনুমোদন নেন না বলে অভিযোগ আছে।

ইউজিসির উল্লিখিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করছেন ৩৩১১ জন। তাদের মধ্যে ৯০৪ জনই অধ্যাপক। এছাড়া সহযোগী অধ্যাপক ৪৩৭ জন, সহকারী অধ্যাপক ৫৬৩ এবং ১২৩০ জন প্রভাষক। এছাড়া অন্যান্য ধরনের খণ্ডকালীন শিক্ষক আছেন ১১৪ জন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, খণ্ডকালীন উল্লিখিত শিক্ষকের বড় একটি অংশ কোনো না কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষক। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে নিজের বিভাগে কোনো রকমে ক্লাস নিয়ে কিংবা ফাঁকি দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/638927