২৬ জানুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৫০

বেপরোয়া চাঁদাবাজি

হ্যালো ভাইজান আস্‌সালামু আলাইকুম। আমি শাহাদাত বলছি। ব্যবসা-বাণিজ্য তো ভালোই করছেন। আমাদেরও পোলাপান আছে। তাদেরকে চালাতে হয়। ৫ কোটি টাকা লাগবে। টাকাটা দিয়ে দিয়েন। আমার ছোট ভাই মোক্তার যোগাযোগ করবে। আর না দিলে কপালে শনি আছে বলে দিলাম। বিদেশে বসে ফোনে হুমকি দিয়ে এভাবেই চাঁদা চান শীর্ষ সন্ত্রাসীরা।

কেউ চাঁদা দিতে অপারগতা জানালে তার বাড়ির আশেপাশে ককটেল বিস্ফোরণ বা ফাঁকা গুলি করে ভয় দেখানো হয়। এরপরেও চাঁদা না দিলে তার ওপর হামলা করে আহত করা হয়। হামলার পরেও চাঁদা না দিলে আরও ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে ঢাকার বৃহত্তর মিরপুরে চাঁদাবাজির ঘটনা আড়ালে-আবডালে বহু বছর ধরে চলছে। তবে এখন এমন ঘটনা প্রকাশ্যেই হরহামেশা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ফোন করে সরাসরি চাঁদা চাওয়ায় এবং চাঁদা না দিলে বিভিন্ন ধরনের অঘটন ঘটনার কারণে ওই এলাকার অনেক বাসিন্দার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সন্ত্রাসীদের ফোন পেয়ে প্রাণের ভয়ে মানুষ নীরবেই দিনের পর দিন চাঁদা দিচ্ছে। মাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটলেও এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা বা জিডি করেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে ভুক্তভোগীরা শুধুমাত্র মৌখিক অভিযোগ দেন। এজন্য চাঁদাবাজির ঘটনাগুলোও গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত হয় না। এ ছাড়া যেসব নম্বর থেকে ফোন আসে সেগুলোও দেশের বাইরের।

তাই তাদেরকে শনাক্তও করা যায় না। ভুক্তভোগীরাও সন্ত্রাসীদের দেশে থাকা কার হাতে চাঁদার টাকা তুলে দেন সে বিষয়ে সঠিক তথ্য দেন না। তবে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনায় সন্ত্রাসী গ্রুপের দেশে থাকা সদস্যরা গ্রেপ্তার হন। জেলহাজতে যাওয়ার আগে জিজ্ঞাসাবাদে দিয়ে যান চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বৃহত্তর মিরপুর এলাকার স্থাপনা নির্মাণ, মাদক ব্যবসা, জমি ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পোশাক কারখানা, বাড়ির মালিক, উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী, চিকিৎসক, ছোট-বড় ব্যবসায়ী, বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতাল, বস্তি, স্থায়ী-অস্থায়ী বাজার, ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা নেন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। বিদেশে থাকা দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী ফোনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে ফোন করে চাঁদা চান। আর এসব চাঁদাবাজিতে ঘুরেফিরে দুই সন্ত্রাসীর নামই বেশি আসছে। আর তারা হলেন- ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শাহাদাত হোসেন ওরফে শাহাদাত ও শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার ইব্রাহিম। মিরপুর এলাকায় শাহাদাত ও ইব্রাহিমের আলাদা আলাদা কমপক্ষে ২০টি গ্রুপ আছে। প্রতি গ্রুপেই ৮ থেকে ১০ জন করে সদস্য আছে। তারা প্রত্যেকেই আগ্নেয়াস্ত্র বহন করে। হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ খুলে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখে। গ্রুপের মাধ্যমেই বিদেশ থেকে আসে সকল নির্দেশ। গ্রুপের সদস্যরা প্রথমে টার্গেট করা ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অর্থ-সম্পদের খোঁজ-খবর নেয়। পরে ওই ব্যক্তির মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে। নম্বর পাঠানো হয় বিদেশে। সেখান থেকে ফোন দেন শাহাদাত ও কিলার ইব্রাহিম। চাঁদা না দেয়ায় মিরপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে চাঁদা চেয়ে না পাওয়ায় ককটেল বিস্ফোরণ, গুলি ও আগুন লাগিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় থানায় মামলা ও জিডি হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম দিন সন্ধ্যায় মিরপুরের ভাষানটেকে ঘটে অপ্রীতিকর এক ঘটনা। সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটের দিকে ১৫ নং ওয়ার্ডের ভাষানটেক বাড়ি ও ফ্ল্যাট মালিকদের সংগঠন ওয়েলফার সোসাইটির অফিসের ভেতর মুখ ঢেকে প্রবেশ করে অস্ত্রধারী ১৫ জন সন্ত্রাসী। তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। অফিসে ঢোকার সময় তারা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। আতঙ্কে প্রাণ বাঁচাতে সেখানে আগে থেকে বসা অন্তত ২০/৩০ ব্যক্তি দৌড়ে পালিয়ে যান। পরে ওই সন্ত্রাসীরা সেখানে বসে থাকা ভাষানটেক এলাকার ঠিকাদার মো. হোসেন আলী (৬২)কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও তার পায়ে গুলি করে মারাত্মকভাবে আহত করে পালিয়ে যায়। আহত হোসেন আলী এখনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর পক্ষ থেকে ভাষানটেক থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার ইব্রাহিমের শ্যালক মো. সাহেদ (২৬)কে প্রধান আসামি করে আরও ৬ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৬/৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলো- মো. রায়হান (২৭), মো. ইমন (২৫) মো. শাহজামাল ওরফে সাবু (২৮), মো. সুজন (৩০), মো. তানভীর (২৬) ও জাহিন (২৪)। মামলার পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রথমে রায়হানকে গ্রেপ্তার করে। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে রায়হান ওই হামলায় অংশগ্রহণ করেছিল বলে জানায়। তবে ডিবি জানতে পেরেছে ওই হামলায় যারা ছিল তারা রায়হানের নেতৃত্বেই অংশ নিয়েছিল।

বিদেশ থেকে কিলার ইব্রাহিমের নির্দেশেই হামলা হয়। রায়হান ডিবিকে জানায়, ভাষানটেক এলাকার হর্তাকর্তা একজনই। আর সে হচ্ছে ইব্রাহিম। ওই এলাকায় তার শতাধিক এজেন্ট আছে। এলাকায় একটি শিশু জন্মগ্রহণ করলেও ইব্রাহিমের কাছে খবর যায় আগে। এলাকার প্রতিটি সেক্টর থেকে চাঁদা তোলা হয় ইব্রাহিমের নামে। ডিবি’র একটি সূত্র জানিয়েছে, চাঁদাবাজি ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে ওই সন্ধ্যায় হোসেন আলীকে ভয় দেখানোর জন্য হামলা চালানো হয়। কারণ ইব্রাহিম ও হোসেন দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে আসছে। আধিপত্য বিস্তার ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ইব্রাহিম কাজ এনে দিতো হোসেনকে। ইব্রাহিম বিদেশে থেকেও সবকিছু তার অনুসারীদের দিয়ে করাতো। হোসেনের অফিসে সবসময় যাতায়াত করতো তার শ্যালক সাহেদ। সে হোসেনের অফিসের ভেতরে দরজা বন্ধ করে মাদক সেবন করতো। এ অবস্থায় প্রকল্প থেকে সরঞ্জামি সরানোর জন্য থানায় একটি জিডি করে রাখেন। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানায়, হামলার ঘটনার পর থেকে ইব্রাহিমের অনুসারীরা পলাতক রয়েছে। রায়হানের পর রিফাত নামের আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হামলায় অংশগ্রহণকারী অনেককে শনাক্ত করা হয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবির ফোন পেয়ে রূপনগর থানায় জিডি করেন ডার্ড গ্রুপ কর্তৃপক্ষ। গত বছরের ১৩ই এপ্রিল ঘটনাটি ঘটে। ওইদিন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ডার্ড গ্রুপের ম্যানেজার সাজিদ ফেরদৌস সানীর ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে শাহাদাত বাহিনীর প্রধান শাহাদাত পরিচয়ে +৯০৩৫৬২৩৫৬৬ মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। সেইসঙ্গে শাহাদাত বলেন, তার ছোট ভাই মোক্তার পরবর্তীতে যোগাযোগ করবে।

কিছু সময় পরে দুপুর ১টা ২৬ মিনিটে ০১৭৯৮৮৮৮৮৮৮ মোবাইল নম্বর থেকে সানীর মোবাইল নম্বরে ফোন করে শাহাদাতের ছোট ভাই পরিচয় দিয়ে মোক্তার ৫ কোটি টাকা চায়। এই টাকা না দিলে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্রয় নিলে কোম্পানি ম্যানেজার সানীর বড় ধরনের ক্ষতি ও মৃত্যুর হুমকি দেয়। আবার ফোন করে কখন কীভাবে টাকা গ্রহণ করবে সেটি জানায়। এ ঘটনায় পরেরদিন রূপনগর থানায় করা জিডিতে ডার্ড গ্রুপ খুবই উদ্বিগ্ন হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। জিডির সূত্র ধরে তদন্ত করে ডিবি পুলিশ। ডিবি জানিয়েছে, জিডি করলেও আমাদের ধারণা ডার্ড গ্রুপ শাহাদাতকে টাকা দিয়েছে। কারণ চাঁদা না দিলে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা তাদের প্রতিনিধি দিয়ে ককটেল ও ফাঁকা গুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ডার্ড গ্রুপকে ভয়ভীতি দেখাতে গিয়েও তারা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। অফিসের সামনে থাকা রিকশায় আগুন ধরিয়ে ভয় দেখায়। ডিবিসূত্র আরও জানিয়েছে, ২০২২ সালের ১৪ই অক্টোবর আরেকটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের পরিচয়ে বিদেশি নম্বর থেকে ফোন দিয়ে পল্লবীর এক ব্যবসায়ীর কাছে বড় অঙ্কের চাঁদা চাওয়া হয়। চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় ওই ব্যবসায়ীর দোকানের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ করে ভয়ভীতি দেখানো হয়। পরে ওই ব্যবসায়ী প্রাণের ভয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কিছু না জানিয়ে চাঁদা দেন।

একইভাবে শাহাদাত বাহিনীর ফোন পেয়ে চাঁদা না দেয়ায় আরেক ব্যবসায়ী মোটরসাইকেলে করে বাসায় যাওয়ার সময় তার পাশে ককটেল বিস্ফোরণ করা হয়। ওই ব্যবসায়ীও ভয়ে চাঁদা দেন বলে জানায় ডিবি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, মিরপুর এলাকায় দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামে চাঁদাবাজির অনেক ঘটনাই ঘটছে। কিন্তু ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা-জিডি করেন না। যেসব মোবাইল নম্বর থেকে ফোন দিয়ে চাঁদা চাওয়া হয় সেগুলো দেশের বাইরের। যাদের কাছে চাঁদা চাওয়া হয় তারা যদি আমাদেরকে সহযোগিতা না করেন তাহলে এসব চাঁদাবাজদের ধরা কঠিন হবে। তবে চাঁদার জন্য যাদেরকে ভয়ভীতি বা আতঙ্কের জন্য বিস্ফোরণ করা হচ্ছে এসব ঘটনা নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। সূত্রগুলো বলছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে মিরপুরের নিউ শাহাজালাল আবাসিক এলাকার হোটেল ব্যবসায়ী জুনায়েদের কাছে শাহাদাতের পরিচয় দিয়ে ভারত থেকে ১ কোটি টাকা চাঁদা চেয়ে ফোন আসে। চাঁদা দিতে অসম্মতি প্রকাশ করায় ওই বছরের ১লা ফেব্রুয়ারি রাতে গুলি করে হত্যা করা হয় জুনায়েদকে।

হত্যা মিশনে ছিল শাহাদাতের কিলার গ্রুপের সদস্যরা। এর আগে ২০১৫ সালে পল্লবীর ওষুধ ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম রাসেলকে চাঁদার জন্য হত্যা করা হয়। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, গত কয়েক বছরে পুলিশ, ডিবি ও র‌্যাব শাহাদাত এবং ইব্রাহিমের গ্রুপের অন্তত অর্ধশতাধিক শীর্ষ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। যারা তাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড, ক্যাশিয়ার, প্রধান শুটার হিসেবে পরিচিত ছিল। বন্দুকযুদ্ধেও অনেকে মারা যায়। ২০১৯ সালের ১৯শে আগস্ট শাহাদাত বাহিনীর কিলার নজরুল ওরফে মিঠুকে সাভার থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৪ এর একটি দল। তার কাছে পাওয়া যায় বিদেশি পিস্তল ও ৪ রাউন্ড গুলি। মিঠু একাধিক হত্যা ও অস্ত্র মামলার আসামি। ২৫শে জুলাই মিরপুরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় শাহাদাত গ্রুপের কিলার ব্যাঙ্গা বাবু। সে ২৬টি খুন করেছে। শাহাদাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো সে। র‌্যাব শাহাদাত বাহিনীর অন্যতম সদস্য আবু হানিফ বাদল ওরফে ডিশ বাদলকে অস্ত্র ও গুলিসহ ক্যান্টনমেন্ট থানার মাটিকাটা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। মিরপুর, পল্লবী ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের একাধিক গ্রুপ।

https://mzamin.com/news.php?news=40078