২৪ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, ৬:৫৬

কর্ণফুলী গ্যাসে লুট

দেশে দফায় দফায় বাড়তি গ্যাসের দাম দিচ্ছে জনগণ। অতিরিক্ত গ্যাসের দাম দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষ। কিন্তু গ্যাস বিতরণ কোম্পানি জনগণের সেই কষ্টের হাজার কোটি টাকা নিয়ে লভ্যাংশ বণ্টন করছে কর্মচারীদের মধ্যে। যা তারা বোনাস হিসেবে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) এর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ।

বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস বিক্রি বাবদ একটা মাশুল (বিতরণ মার্জিন) পায়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নির্দেশনা অনুসারে এই মার্জিন ব্যতীত মুনাফার বাড়তি অর্থ নিজেদের কাছে রাখতে পারে না গ্যাস কোম্পানিগুলো। কিন্তু কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানির (কাফকো) কাছে বেশি দামে বিক্রি করা গ্যাসের লভ্যাংশ পেট্রোবাংলাকে গত ১০ বছর দেয়নি কর্ণফুলী গ্যাস (কেজিডিসিএল)। এর পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। এই অর্থ থেকে ৩৮৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী বোনাস পাচ্ছেন নিয়মিত। শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরে একেকজন বোনাস নিয়েছেন ১৮ লাখ টাকা।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, ২০১০ সালে বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানি ভেঙে চট্টগ্রাম এলাকায় কেজিডিসিএল গঠিত হয়।

শুরু থেকেই কাফকো’র সঙ্গে পৃথক চুক্তি অনুসারে অন্য সার কারখানার চেয়ে বেশি দামে গ্যাস বিক্রি করা হতো। বাখরাবাদ ২০১০ সাল পর্যন্ত কাফকো’র কাছে আদায় করা অতিরিক্ত অর্থ পুরোপুরি পেট্রোবাংলাকে পরিশোধ করেছে। কেজিডিসিএল ২০১০ সালের জুলাই মাস থেকে এখন পর্যন্ত বিইআরসি’র নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত হারে কাফকো’র কাছে গ্যাস বিক্রি করলেও বাড়তি টাকার একটি বড় অংশই পেট্রোবাংলার খাতে জমা করেনি। এ বিষয়ে হিসাব চেয়ে পেট্রোবাংলা কেজিডিসিএলকে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১১টি চিঠি পাঠালেও কোনো সাড়া মেলেনি।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে জ্বালানি বিভাগের এক সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কাফকো’র কাছ থেকে বিইআরসি নির্ধারিত গ্যাসের মূল্যের অতিরিক্ত অর্থের অর্ধেক পেট্রোবাংলার কোষাগারে দিতে হবে। সে সময় কাফকো’র প্রতি ইউনিটের দাম ছিল ১২ টাকা আর বিইআরসি অন্য সার কারখানার জন্য নির্ধারণ করেছিল প্রতি ঘনমিটার ২ টাকা ৭১ পয়সা। অর্থাৎ ১ ইউনিটেই কাফকো’র কাছ থেকে কেজিডিসিএল অতিরিক্ত পেতো ৯ টাকা ২৯ পয়সা। পরে অন্য সার কারখানার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কাফকো’র দামও বেড়েছে। ২০১৯ সালের ৩০শে জুন বিইআরসি সার কারখানার প্রতি ঘনমিটারে দাম ৪.৪৫ টাকা এবং ২০২২ সালের জুনে তা বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটার ১৬ টাকা করে। এখন কাফকো’র কাছে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়।

পেট্রোবাংলার হিসাব বলছে, ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত কাফকো’র কাছে কেজিডিসিএল ৪৩৯ কোটি ঘনমিটারের বেশি গ্যাস বিক্রি করেছে। কাফকো’র সঙ্গে চুক্তি অনুসারে এর দাম ৫ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা।

অন্য সার কারখানার নির্ধারিত মূল্য অনুসারে এই পরিমাণ গ্যাসের দাম ১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। ফলে কেজিডিসিএলের বাড়তি আয় ৩ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেজিডিসিএল পেট্রোবাংলাকে দিয়েছে মাত্র ৯৬১ কোটি টাকা। বিইআরসি’র নির্দেশনা অনুসারে পেট্রোবাংলা পাবে ২ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা।
গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি করছে সরকার। প্রতি ঘনমিটার এলএনজি আমদানিতে পেট্রোবাংলার খরচ হয় ৪০-৫০ টাকা। ২০১৯ সালের বিইআরসি’র আদেশ অনুসারে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর থেকে পেট্রোবাংলা গড়ে পেতো ৭ টাকা ১৭ পয়সা। ২০২২ সালের জুনে এই দাম বেড়ে হয় ১১ টাকা ৯৭ পয়সা।

গত সপ্তাহে জ্বালানি বিভাগ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পর এই গড় দাম দাঁড়িয়েছে ২১ টাকা ৬৭ পয়সা। অর্থাৎ কয়েক দফা দাম বৃদ্ধি করলেও এলএনজি আমদানিতে বিপুল ভর্তুকি লাগছে। এই ভর্তুকির অর্থ সংস্থানের জন্য কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত মুনাফা পেট্রোবাংলাকে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল বিইআরসি। কিন্তু কর্ণফুলী সেই কথায় কান দেয়নি। সূত্র জানায়, লভ্যাংশের ৫ শতাংশ কর্মচারীদের বোনাস তহবিলে জমা হয়। এর ৮০ শতাংশ কর্মচারীদের বোনাস হিসেবে দেয়া হয়। বাকি ২০ শতাংশ ১০ শতাংশ করে আরও দুটি তহবিলে জমা হয়।

এ বিষয়ে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমত উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, দেশে এটি আর্থিক বিশৃঙ্খলা। ভয়ঙ্কর লুটপাট। বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত হওয়া উচিত। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, পেট্রোবাংলা কীভাবে এটি সহ্য করছে। মনে হচ্ছে পদাধিকার বলে যারা বোর্ডের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন তারাও ভাগবাটোয়ারায় আছেন। তারা কেন প্রতিবাদ করলেন না। এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। এটা জনগণের টাকা। ওই কোম্পানির কর্মচারীরা অন্যান্য কোম্পানির কর্মচারীরা যে ধরনের সুবিধা পায়, স্রেফ তারাও সেই সুবিধা পাবেন। এরচেয়ে বাড়তি কিছু নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি নতুন এসেছেন। তার আসার আগেই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে লভ্যাংশ বণ্টন করা হয়েছে। তিনি জানান, পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে বিইআরসি’র নির্দেশনার বিরুদ্ধে কমিশনে আপিল করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিইআরসি’র চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল মানবজমিনকে বলেন, বিষয়টি আমি মিডিয়ায় দেখেছি। কাফকো’র কাছে অতিরিক্ত দামে গ্যাস বিক্রি ও লভ্যাংশ বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে কমিশনে উত্থাপিত হলে আলোচনা হবে। তখন সিদ্ধান্ত হলে খতিয়ে দেখা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

https://mzamin.com/news.php?news=39759