২৩ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ১২:৪৩

এক বছরে রোগী ও মৃত্যু দ্বিগুণ

দেশে এক বছরের ব্যবধানে কিডনি রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এই তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৮০ শতাংশ রোগী কিডনি বিকল হওয়ার পর হাসপাতালে আসে। এই রোগীর ৯০ শতাংশই চিকিৎসা ও ডায়ালিসিস খরচ মেটাতে পারে না। এতে প্রতিবছর কিডনির রোগে মৃত্যু বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে ৩৯ লাখ ১৪ হাজার ৫৪৪ জনের তথ্য সংগ্রহ করে অধিদপ্তর। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৪০৭ জনই কিডনির রোগী। তাদের মধ্যে ৫৪১ জন মারা যায়। ২০২২ সালে কিডনি রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয় ৩৩ হাজার ৩০৬। মৃত্যু হয় এক হাজার ২৭ জনের। অর্থাৎ এক বছরে কিডনি রোগী ও মৃত্যু বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

এদিকে কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডায়ালিসিস সেন্টারের সংখ্যা ১৬১। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই বেসরকারি। এসব সেন্টারের ৭০ শতাংশই ঢাকায়। বাংলাদেশে দুই কোটি রোগীর বিপরীতে নেফ্রোলজিস্ট মাত্র ২০০ জন।
কিডনি ইনস্টিটিউটে শয্যা খালি

নেই : গত ১৬ ও ১৯ জানুয়ারি জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে রোগী ও স্বজনের ভিড় দেখা যায়। এ সময় এক রোগীর স্বজন রাহিমা বেগম বলেন, ‘দিন দিন অসুখ বাড়তাছে। অন কোনে যাইতাম, আই গরিব মানুষ, আঙ্গো যাওনের তো জায়গা নাই। এই লইয়া সাতবার আইছি, হেতারা কয় বিছানা খালি নাই। এদিকে আইতে-যাইতে ফয়সা শ্যাষ। কী দিয়া চিকিৎসা করাইয়ুম। আইজও ভর্তি দেয়নো।’

রাহিমা জানান, তাঁর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। তাঁর একমাত্র ছেলে মো. জহিরের (২৬) কিডনিতে পাথর ধরা পড়ে ছয় মাস আগে। ব্যথায় কাতর ছেলেকে নিয়ে এ পর্যন্ত সাতবার এই হাসপাতালে এসেছেন তিনি। কিন্তু শয্যা খালি না থাকায় জহিরকে কিছুতেই ভর্তি করানো যাচ্ছে না।
জহিরের মতো একই সমস্যায় ভুগছেন পটুয়াখালীর রিপন মিয়া। হাতে থাকা ব্যবস্থাপত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এর আগে ছয়বার আসছি। বিছানা খালি নাই লিখে বিদায় দেয়। আজ ভর্তি দিয়েছে। কিন্তু এই সময়ে আমার শরীর খুব খারাপের দিকে চলে গেছে।’

কিডনি রোগীদের একমাত্র সরকারি এই বিশেষায়িত হাসপাতালে মোট ১০টি ওয়ার্ডে ১৫০টি শয্যা আছে। এর মধ্যে শিশুর দুটি, নারীর তিনটি, পুরুষের চারটি এবং জরুরি বিভাগ একটি। হাসপাতালটির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান জানান, গত বছরের মার্চে এই হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে এখন তা হয়নি। হয়তো শিগগিরই হয়ে যাবে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, নেফ্রোলজির বহির্বিভাগে গড়ে প্রতিদিন রোগী আসে ৩৫০ জন। ভর্তির সুযোগ পায় ১০ থেকে ১৫ জন। আর ইউরোলজি বিভাগে গড়ে প্রতিদিন রোগী আসে ১২০ জন। ভর্তির সুযোগ পায় আট থেকে ১০ জন।

কিডনি রোগীর সংখ্যা কত? : বাংলাদেশে কিডনি রোগীর প্রকৃত সংখ্যা কত তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। ২০০৮ সালে কিডনি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ঢাকার সাভারের এক জরিপের ওপর ভিত্তি করে বলা হয়েছিল, এই সংখ্যা দুই কোটি, যারা কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভুগছে।

কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ মনে করেন, এ সংখ্যা গত দুই বছরে আরো বেড়েছে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমরা যে গবেষণাগুলো করেছি সেখানে কিডনি রোগের প্রধান তিনটি কারণ পাওয়া গেছে। প্রথমত, প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হওয়া; দ্বিতীয়ত, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস; তৃতীয়ত, উচ্চ রক্তচাপ। উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ না খেলেও কিডনি বিকল হতে পারে। এ ছাড়া প্রস্রাবে ইনফেকশন, কিডনিতে পাথর, ক্রিয়েটিনিন না দেখে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, ভেজাল খাদ্য, পলিসিস্টিক কিডনি রোগ, জন্মগত কিডনি রোগ ও অন্যান্য কারণ উল্লেখযোগ্য।’
বছরে ৪০ হাজার রোগীর কিডনি

বিকল : রাজধানীর গাবতলীর বাসিন্দা মোহাম্মদ রুবেল (৩২)। হঠাৎ তাঁর জ্বর আসে। ঘন ঘন বমিও হচ্ছিল। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে পরীক্ষার পর জানতে পারেন তাঁর দুটি কিডনি বিকল। রোগ শনাক্তের এক মাসের মাথায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি।

বৃহস্পতিবার জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে কথা হলে রুবেলের স্ত্রী মাহিমা আক্তার বলেন, ‘গত এক মাসে চারটা ডায়ালিসিস করিয়েছি। একেকবার সাত থেকে আট হাজার টাকা খরচ। এখন আর চিকিৎসা চালানোর মতো অবস্থা আমাদের নেই।’

বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম বলেন, কিডনি রোগীদের জন্য বড় সমস্যা হলো ৮০ শতাংশ বিকল হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না। যখন উপসর্গ দেখা দেয় তখন প্রায় বিকল হয়ে যায়। এর কারণ বিভিন্ন ওষুধ সেবন, এর ভেতর অ্যান্টিবায়োটিক অন্যতম। এ ছাড়া ব্যথানাশক ওষুধ খেলেও হঠাৎ করে কিডনি বিকল হয়ে যায়। এর বাইরে খুব বেশি ডায়রিয়া, অতিরিক্ত বমি বা রক্তক্ষরণ হলেও কিডনির সমস্যা হতে পারে।
তিনি বলেন, ২০০৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে বছরে ৪০ হাজার রোগীর কিডনি বিকল হচ্ছে। এর মধ্যে ৯-১০ হাজার রোগী ডায়ালিসিস সুবিধা পায়। তবে ব্যয়বহুল হওয়ায় অন্যরা ডায়ালিসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধার মধ্যে আসতে পারে না। কারণ এই চিকিৎসায় যে অর্থ ব্যয় হয়, সেই সামর্থ্য আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের নেই।’

ডায়ালিসিস ও চিকিৎসকের সংকট : কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডায়ালিসিস সেন্টারের সংখ্যা ১৬১। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই বেসরকারি। এসব সেন্টারের ৭০ শতাংশই ঢাকায়। বাংলাদেশে দুই কোটি রোগীর বিপরীতে নেফ্রোলজিস্ট মাত্র ২০০ জন, যা বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য খুবই অপ্রতুল।

সরকার ২০২০ সালে দেশের ২২টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৫০ শয্যা এবং ৪৪টি জেলা সদর হাসপাতালে ১০টি করে ডায়ালিসিস সেন্টার স্থাপনের একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। প্রকল্পের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

এই প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক মো. বাবরুল আলম বলেন, ‘২০২০ সাল থেকে দেশে কভিড রোগী বেড়ে যাওয়ায় কাজের সুযোগ কমে যায়। এখন যেহেতু রোগী কমেছে, কাজ আবারও চালু হয়েছে। এরই মধ্যে আটটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কাজ শুরু হচ্ছে। আশা করছি, বাকিগুলো এক বছরের মধ্যে হয়ে যাবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/23/1234581