২১ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ৫:৪৭

উপাচার্য ছাড়া চলে ৩০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

দেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ছাড়াই চলে। ২০১৪ সাল থেকে এই অবস্থা চলে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চলতি মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই বলে জানানো হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য নেই, ৪২টিতে নেই কোষাধ্যক্ষ।

ইউজিসির কর্মকর্তারা বলছেন, এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদের কোনোটি শূন্য থাকলে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল পর্যন্ত অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৮। এর মধ্যে ৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৬৯টি প্রতিষ্ঠানে আচার্য কর্তৃক নিয়োগ করা উপাচার্য ছিলেন। আগের শিক্ষাবর্ষ ২০২০ সালে ৯৬ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হলেও সে সময় ৭৩ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ছিলেন। এ বছর নতুন তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হলেও চারজন উপাচার্যের সংখ্যা কমেছে। শুধু উপাচার্য নয়, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব পদও শূন্য।

ইউজিসির কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব পদ শূন্য থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রশাসনিক কার্যক্রম। এতে শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণা ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। একই সঙ্গে এসব পদ শূন্য রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ আইন অনুযায়ী, এসব পদে আচার্য কর্তৃক নিয়োগ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সম্প্রতি ইউজিসির ৪৮তম প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে পরিচালিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই উপাচার্যের পদ ফাঁকা ছিল। এ ছাড়া ৭৫টি প্রতিষ্ঠানে উপ-উপাচার্যের পদ ফাঁকা এবং ৪২টিতে কোষাধ্যক্ষ নেই। মাত্র ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই তিনটি পদ পূরণ রয়েছে।
২০২০ সালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে তিনটি। এ সময় উপাচার্যের শূন্যপদের সংখ্যা বেড়েছে চারটি। উপ-উপাচার্য পদে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে, কোষাধ্যক্ষ পদে তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তিন পদেই চার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বেড়েছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অন্যতম কাজ তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসম্পন্ন পাঠদান নিশ্চিত করা; শিক্ষকদের গবেষণায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তা তদারক করা; গবেষণার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন তহবিল থেকে পর্যাপ্ত বরাদ্দের ব্যবস্থা করা। গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি করাও উপাচার্যের অন্যতম কাজ।

উপ-উপাচার্য মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্প মেয়াদি শিক্ষা কার্যক্রম পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করে থাকেন। উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে চলতি দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০-এর ১৪ ধারায় বলা হয়, কোষাধ্যক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল তদারক ও অর্থসংক্রান্ত নীতি সম্পর্কে পরামর্শ দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি ও বিনিয়োগ পরিচালনা করবেন। বার্ষিক বাজেট ও হিসাব বিবরণী পেশ করার দায়িত্বে থাকবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব চুক্তিতে তিনি স্বাক্ষর করবেন। বরাদ্দের অর্থ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় তদারক করবেন। তিনি সিন্ডিকেট, অর্থ কমিটি, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটির সদস্য।

ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় বছর ধরে কোনো উপাচার্য নেই। সেখানে নানা সমস্যা বিদ্যমান। নাম প্রকাশ না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক কালের কণ্ঠকে জানান, উপাচার্য না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা কার্যক্রম পরিকল্পনা, প্রশাসনিক পরিকল্পনা ও আর্থিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। উপ-উপাচার্য চলতি দায়িত্বে দৈনন্দিন কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। সর্বোচ্চ দুই থেকে চার মাসের পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন। এতে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক স্বচ্ছতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর উপাচার্য না থাকে, তবে এসব ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে অন্তত ১৬ বছর সময় প্রয়োজন।

একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পর্যায়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয় না। এর মধ্যে প্রধান ও অন্যতম কারণ ট্রাস্টি বোর্ডের ক্ষমতা চর্চা ও আর্থিক অনিয়ম। এ সময় উপ-উপাচার্য দিয়ে এমন সব সিদ্ধান্ত পাস করিয়ে নেবে, যার ক্ষতি ১০ বছরেও পূরণ হবে না। সংবাদমাধ্যমে আসা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দুর্নীতিকে উদাহরণ হিসেবে দেখছেন তাঁরা।

তাঁরা বলছেন, আচার্য থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য না থাকলে ট্রাস্টি বোর্ডকে প্রশ্ন করার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কোনো পদ থাকে না। কারণ উপ-উপাচার্য চলতি দায়িত্ব পালন করেন। যখন-তখন তাঁর পরিবর্তন হতে পারে। উপাচার্য নিয়োগ না দেওয়ার অন্য দুই কারণের মধ্যে রয়েছে, তাঁর নিয়োগে অনেক প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। আবার নীতিমালা অনুযায়ী যোগ্য উপাচার্য পাওয়া কষ্টসাধ্য বিষয়।

ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ খুব গুরুত্বপূর্ণ পদ। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় উপ-উপাচার্যেরও ভূমিকা রয়েছে। এগুলো সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত। এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসির মতামত নেওয়া উচিত।

সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এসব পদে কেউ না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। একদিকে যেমন একাডেমিক স্বচ্ছতা থাকে না অন্যদিকে আর্থিক স্বচ্ছতা থাকে না।

ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছরে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশা ইউনিভার্সিটিসহ মোট পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কাউন্সিলের কোনো সভা হয়নি। অনুরূপভাবে অর্থ কমিটির কোনো সভা হয়নি ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সিন্ডিকেট সভা হয়নি। মাত্র ৬১ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে আর্থিক বিবরণী ইউজিসির পর্যবেক্ষণ সেলে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধান এই তিন কর্মকর্তা ছাড়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। এসব পদে নিয়োগে আইন ও নীতিমালা রয়েছে, ফলে নিয়োগ ছাড়া এসব কার্যক্রম পরিচালনা বেআইনি। নিয়ম অনুসারে এই তিন পদে নিয়োগের বিষয়ে ইউজিসি পর্যবেক্ষণ ও তদন্ত করে থাকে। কার্যত ব্যবস্থা গ্রহণে সেই প্রতিবেদন ও সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তবে জনবল সমস্যা ও নানা তদবিরসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় মন্ত্রণালয় থেকে অনেক ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করা হয় না। অনিয়মের কারণে দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয় নিষিদ্ধ করা হলেও পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয় না। এর মধ্যে শুধু দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কেনোটি বন্ধ করা যায়নি। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি শুরু থেকেই বেআইনিভাবে চলছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/21/1233261