২১ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ৫:৪৫

যন্ত্রপাতি আমদানি এলসি তলানিতে

ডলার সঙ্কট, দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন ‘ধস’ নামার শঙ্কা লোকসান হওয়ার আশঙ্কা থেকে কোনো ব্যবসায়ী এই সময়ে শিল্প স্থাপন করবে না

আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া নানামুখী পদক্ষেপের সুফল মিলতে শুরু করেছে। কমছে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ। আপাতদৃষ্টিতে এতে সরকার পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারে। কিন্তু এর উল্টোপিঠও আছে। দেশে নতুন বিনিয়োগের অন্যতম নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি এক ধাক্কায় তলানিতে নেমে এসেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। এতে দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন ‘ধস’ নামার একটা অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছে। কারখানা সম্প্রসারণ হোক অথবা নতুন কারখানা স্থাপন হোক মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমা- এটাই হলো তার পরিষ্কার ইঙ্গিত।
সূত্র মতে, দেশে ডলারের সঙ্কট ও বৈশ্বিক বাণিজ্যিক অস্থিরতার কারণে ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল, ইন্টারমিডিয়েট গুডস ও কনজ্যুমার গুডস তথা ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ব্যাপক পতন হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ক্যাপিটাল মেশিনারির আমদানি দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হওয়া ৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের ৬৫ দশমিক ৩২ শতাংশ কম। একইসঙ্গে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ৪ দশমিক ১২ ও ১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্রমান্বয়ে ছিল ৪ দশমিক ৬৯ ও ১ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে ২০২১ সালের জুলাই মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির দ্বিগুণেরও বেশি ৫০ কোটি ডলারের এলসি খুলেছিলেন শিল্পেদ্যোক্তারা। এর অর্থ হচ্ছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা কলকারখানা স্থাপনে আগের চেয়ে যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। টাকার বিপরীতে আমেরিকান মুদ্রা ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলেছেন, পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংকগুলো ১১০ টাকার বেশি নিচ্ছে। এতে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। এত বেশি খরচ করে যন্ত্রপাতি আমদানি করে শিল্প স্থাপন করলে সেই শিল্প লাভজনক হবে কি না- তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। সে কারণেই সবাই মূলধনি যন্ত্রপাতি কমিয়ে দিয়েছেন বলে মনে করছেন তারা।

ব্যাংকাররা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। বিদেশি বায়ারদের দেশ থেকে পোশাক আমদানির চাহিদা কমে গেছে। একইসঙ্গে দেশের ব্যাংকগুলোতে ডলারের সঙ্কট থাকায় ব্যবসায়ীরা চাহিদা থাকলেও আমদানি করতে পারছে না। যার কারণে সকল ধরণের আমদানির পরিমাণ কমেছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরের মধ্যে ইন্টারমিডিয়েট গুডস আমদানি হয়েছে ২ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরের এই সময়ে ইন্টারমিডিয়েট গুডস আমদানি কমেছে ৩৩ দশমিক ১৮ শতাংশ।

সাধারণত মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, আগামী দিনগুলোতে দেশে শিল্প খাতে বিনিয়োগ কমবে। আর বিনিয়োগ কমা মানে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে না। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না। সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অথচ স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেল এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির যে আবহ দেখা দিয়েছিল, তা কিছুটা হলেও হোঁচট খেয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতির গবেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এবং নির্বাহী পরিচালক মেসবাহুল হক বলেন, আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমানোর একটা প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দেশের উৎপাদনে ক্যাপাসিটি এনহ্যান্সমেন্ট কমে আসবে। উৎপাদনকারীরা উৎপাদন বাড়াতে চাইলেই ক্যাপিটাল মেশিনারির আমদানি বাড়ে। সামনে কী হতে যাচ্ছে এটা কেউ বলতে পারছে না। যার ফলে ক্যাপিটাল মেশিনারি ও ইন্ড্রাস্টিয়াল র’ ম্যাটারিয়াল আমদানি কমেছে। তিনি বলেন, গত বছর আমাদের যে পরিমাণে ক্যাপাসিটি এনহ্যান্সমেন্ট হয়েছে সেই পরিমাণ অর্ডার পূরণ করাই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ন্যায় এবছরও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির চাহিদা নেই। আমাদের বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলতে হবে।

গত বছরের এপ্রিল থেকে মূল্যস্ফীতি, ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পণ্য আমদানিতে লাগাম দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। একের পর এক নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানিতে নানা শর্তের কারণে ২০২২ (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত এলসি ওপেনিং কমেছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এলসি ওপেনিংয়ের প্রভিশনাল তথ্যে এই সময়ে দেখিয়েছে যে, প্রায় ১২ বিলিয়নের মধ্যে এলসি ওপেনিং কমেছে। ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এলসি ওপেনিং হয় ৪৪ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ এর একই সময় এলসি ওপেনিং হয় ৩৪ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার। এদিকে বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। যা ছিল যেকোন অর্থবছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। তবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারির ১৯ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ১০ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করতে হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, গত অর্থবছরের অনেক এলসি পেমেন্ট ডেফার্ড ছিল। যার বড় পরিমাণে পেমেন্ট চলতি অর্থবছরের মধ্যে করতে হয়েছে। আশা করছি এখন এলসি সেটেলমেন্টের পরিমাণ কমে আসবে। যা গত কয়েকমাস যাবত দেখছি। তিনি আরও বলেন, আমাদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে, একইসঙ্গে রফতানির পরিমাণও বাড়ছে। আশা করা যাচ্ছে সামনের সময়ে ডলার বিক্রির পরিমাণ কমে আসবে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৩ এর জানুয়ারি-জুন সময়ের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, চলতি অর্থবছর শেষে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। গত বুধবার পর্যন্ত রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। যদিও ২০২১ এর আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার।

একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার পরিমাণ খুবই কম। কারণ তারা এই সময়ে এলসি খোলার চেয়ে ডলার সংগ্রহে বেশি নজর দিচ্ছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে। আগে যে পণ্য ১০০ টাকায় কেনা যেত, এখন প্রায় ১২০ টাকা লাগছে। যার কারণে বিভিন্ন ধরণের পণ্য আমদানির পরিমাণ কম।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রায় ২০টির বেশি ব্যাংকে ডলারের ব্যাপক সঙ্কট রয়েছে। এর মধ্যে অনেক ব্যবসায়ীরা কনজ্যুমার ও ইন্টারমিডিয়েট গুডস আমদানির জন্য এলসি খুলতে চাচ্ছে। তবে ব্যাংকগুলোতে ডলার না থাকায় তারা এলসি খুলতে পারছে না।

‘মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি না কমে অন্য সব পণ্যের এলসি কমলে খুব ভালো হতো’ উল্লেখ করে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমা মানে, ভবিষ্যতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। অর্থনীতিতে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, একটি কঠিন সময় পার করছে গোটা বিশ্ব। আমরাও তার বাইরে নই। এই অবস্থায় ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। স্বাভাবিক কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছেন। বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। পরিস্তিতি যখন স্বাভাবিক হবে, তখন আবার আমদানি করবেন। কিন্তু কবে স্বাভাবিক হবে, সেটাই এখন বড় বিষয়। তিনি বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে বাজারে ডলারের তীব্র সঙ্কট চলছে। ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন যে ডলার বিক্রি করছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম; সরকারের আমদানি খরচই মিটছে না তাতে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো কোনো ডলার পাচ্ছে না। সে কারণেই তারা প্রবাসীদের কাছ থেকে বেশি দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। বাধ্য হয়ে এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি দর রাখছে।

বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, অন্য সব পণ্যের সঙ্গে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমবে-এটাই স্বাভাবিক। কেননা, ১১৪ টাকা দিয়ে ডলার কিনে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি করে শিল্প স্থাপন করলে, সেই কারখানা যখন উৎপাদনে যাবে-তা থেকে মুনাফা আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে কারণেই উদ্যোক্তারা আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। এতে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ঠিক। কিন্তু লোকসান হতে পারে-এমন আশঙ্কা থেকে তো কোনো ব্যবসায়ী এই সময়ে শিল্প স্থাপন করবে না।

সম্প্রতি মুদ্রাণীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, আমাদের অপ্রয়োজনীয় অনেক এলসি হয়েছে। এছাড়া আমদানির মাধ্যমে অনেক ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং হয়েছে। এখন আমরা সকল আমদানিতে খুব নজরদারি করছি, এতে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং অনেকটাই কমেছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/549879