২০ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ১১:১৪

সেচে খরচ বেড়েছে বিঘায় ৩০০ টাকা

সার, বীজ, কীটনাশকসহ সব কৃষি উপকরণের বাড়তি দাম মাথায় নিয়ে হাঁড় কাপানো শীতে আবাদে ব্যস্ত উত্তরাঞ্চলের চাষি। রংপুরের গঙ্গাচড়ার সদর ইউনিয়নের চেংমারী গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান পাঁচ বিঘা জমিতে শুরু করেছেন বোরো ধানের আবাদ। বিদ্যুতের দাম বাড়ার পর থেকে তাঁর মনে শান্তি নেই। আগে সেচে ঘণ্টায়

৬০ টাকা নিলেও বিদ্যুতের দাম বাড়ার পর এই দামে আর পানি মিলবে না বলে আশঙ্কা তাঁর।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরের আছে রবি ফসলের সুখ্যাতি। গত পাঁচ বছর এ এলাকার কৃষক বোরো আবাদে ঝুঁকেছেন। উপজেলার চরক্লার্কের কৃষক মহি উল্যাহ জানান, গত বোরো মৌসুমে এক বিঘা জমিতে সেচ খরচ ছিল দেড় হাজার টাকা। এ বছর বিঘাপ্রতি সেচ খরচ ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা।

গাজীপুরের শ্রীনগরের তরিকুল ইসলামের ১০ হাজার মুরগির একটি খামার আছে। তিনি জানান, ১ হাজার মুরগি পালনের একটি ছাউনিতে শীতকালে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ খরচ হয় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। গরমে সেই খরচ আরও ৫০ শতাংশের মতো বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে প্রতি ইউনিটে খরচ বাড়বে গড়ে ৫ শতাংশ।

সার, ডিজেল ও প্রাণিজ খাদ্যসহ সব উপকরণের দাম বাড়ার ফলে এমনিতেই চতুর্মুখী চাপে দেশের কৃষি, পোলট্রি ও ডেইরি খাত। এবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে বিদ্যুতের দাম। কৃষিতে ইউনিটপ্রতি ৭ টাকা ১৬ পয়সা থেকে বেড়ে ৭ টাকা ৩৭ পয়সা হয়েছে। এতে কৃষি উদ্যোক্তা ও চাষিরা পড়েছেন বিপদে।
দেশের বেশির ভাগ এলাকায় আমন ধান কাটার পর বোরোর বীজতলা তৈরি হয়েছে। জমিতে সেচের কাজ চলছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে উৎপাদিত ধানের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো মৌসুম থেকে। এ বছর ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বোরো ধান ও রবিশস্য প্রায় পুরোটাই সেচনির্ভর জানিয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বলছে, দেশে কৃষকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৯৭ লাখ ৭৯ হাজার। এর মধ্যে সেচযন্ত্রের আওতায় ১ কোটি ৯৬ লাখ ৪৬ হাজার ৬৪০ জন। শুধু বিদ্যুৎচালিত সেচভুক্ত ৭৩ লাখেরও বেশি কৃষক রয়েছেন। বাকিরা ডিজেলচালিত সেচভুক্ত। গত বছর ডিজেল-কেরোসিন ও সারের দাম বাড়ার ফলে বোরোতে খরচ বেড়েছে ২৯১৪ কোটি টাকা। এর সঙ্গে এবার খরচ যোগ হবে ৫ শতাংশ। সেচের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি চাপ তৈরি করবে।

যশোরের ভাতুড়িয়া গ্রামের কৃষক আমিনুর রহমান বলেন, আগে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিঘাপ্রতি সেচ খরচ দিলেও এখন দিতে হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা। এর বাইরে রোপণ খরচ হচ্ছে বিঘাপ্রতি ২ হাজার ২০০ টাকা। সার, কীটনাশক ও শ্রম খরচ মিটিয়ে শেষ পর্যন্ত ক্ষেতের ফসল ঘরে তুলতে বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে বলে তিনি জানান।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাজদার হোসেন বলেন, ধান ছাড়াও নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত রবি মৌসুমে শীতকালীন সবজি, গম, ভুট্টাসহ প্রধান ফসলগুলো উৎপাদিত হয়। বৃষ্টিহীন এ মৌসুমে সেচ ছাড়া ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়। বিদ্যুতের দাম সামান্য বাড়ানো হলেও সেচযন্ত্রের মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে দিতে পারেন। এ সরকার কৃষিবান্ধব, নিশ্চয়ই কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে কৃষকের ওপর ওই বাড়তি চাপ কমাতে কোনো না কোনো উদ্যোগ নেবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, বোরো চাষে অতিরিক্ত সেচ লাগে। সেচ দিতে যেন পানির অপচয় না হয়, সে জন্য আমরা কৃষকদের লক্ষ্য রাখতে বলেছি।

নতুন করে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে কৃষির পাশাপাশি সংকটে ফেলেছে পোলট্রি ও ডেইরি খামারিদের। তারা বলছেন, এমনিতেই পোলট্রি খাবারের দাম বাড়ার কারণে এ খাতের ব্যবসায়ীরা সংকটে রয়েছেন। বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে সেই সংকট আরও বেড়ে গেছে। এতে শুধু খামারের উৎপাদন খরচ বাড়বে না, মুরগি পালনের অন্য কাঁচামালের দামও বাড়বে। এ চাপ সামাল দিতে হবে খামারিদের। তাতে অনেক খামার বন্ধও হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, একটা মুরগি থেকে সঠিক সময়ে ডিম পেতে হলে সেটিকে দিনে ১৬ ঘণ্টা সূর্য বা কৃত্রিম আলোতে রাখতে হয়। বেশি শীত থাকায় খামারে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার আরও বেশি। নতুন করে খরচ বাড়লে এর প্রভাব বাজারেও পড়তে পারে।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ও বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ৮০ থেকে ৯০ হাজার ছোট-বড় মুরগির খামার আছে। করোনার আগে সংখ্যাটি ছিল ১ লাখ ১০ হাজারের ওপর।

পোলট্রি ছাড়া ডেইরিতেও বিদ্যুতের ব্যবহার হয়। এ খাতের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, প্রাণিজ খাদ্য ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার চাপ সামলাতে না পেরে বহু খামার বন্ধ হয়ে গেছে। ডেইরি ও পোলট্রি খাতে বিদ্যুৎ বিল কৃষি শ্রেণির আওতাভুক্ত করার দাবি জনালেও কেউ আমাদের কথা শুনছে না। আমরা বাণিজ্যিক শ্রেণিতে বিল পরিশোধ করে আসছি। এখন আমাদের বিপদ আরও বেড়ে গেল।

https://samakal.com/bangladesh/article/2301152205