২০ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ১০:৪৮

গ্যাসের দাম পৌনে ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি

শিল্প উদ্যোক্তারা শঙ্কিত

দেশের ইতিহাসে এক সাথে এত বিপুল অঙ্কের মূল্য বর্ধিত করে গ্যাসের দাম আর কখনো নির্ধারণ করা হয়নি। পৌনে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত রেকর্ড এ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ব্যয় যে পরিমাণ বাড়বে তার ভার বহন করা আমাদের ক্রেতাদের যেমন নেই, তেমনি এর ফলে যে লোকসান হবে তা বহন করার মতো সক্ষমতা আমাদের নেই। এ কারণে আমরা রীতিমতো বিস্মিত, উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। কথাগুলো বলেছেন কয়েকজন শিল্প উদ্যোক্তা। তারা বিষয়টি নিয়ে পুনঃপর্যালোচনা করতে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। অন্যথায় দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকে রাখাই দায় হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, গ্যাসের দাম স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে। এক সাথে পৌনে ২০০ শতাংশ দাম বৃদ্ধি এর আগে কখনো ঘটেনি। তিনি বলেন, এ জন্য আমরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। তিনি বলেন, এই অত্যধিক দাম বৃদ্ধির ফলে শুধু ডাইংয়েই উৎপাদন ব্যয় বাড়বে ২৫ শতাংশের ওপরে, যেখানে আমাদের মোট উৎপাদন ব্যয়ের ২৫ ভাগ হয় এই খাতে। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানোর ফলে তাদের মোট যে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে তার ভার বহন করার মতো সক্ষমতা আমাদের নেই। নেই আমাদের ক্রেতাদের। কারণ উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক বাড়লেও আমরা বিদেশী ক্রেতাদের কাচে দাম বাড়াতে পারবো না। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের ক্রেতাদের ক্রয়-ক্ষমতা আর আগের মতো নেই। এই মুহূর্তে তারাও দাম বাড়াতে পারবে না। এক দিকে ব্যয় বেড়ে যাবে, অপর দিকে দাম বাড়ানো যাবে না, এতে যে লোকসান হবে তা কাটানোর সক্ষমতা বেশির ভাগ উদ্যোক্তাদের নেই। এতে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ তারা গ্যাসের বিল পরিশোধ করতে পারবেন না। তিতাস কর্তৃপক্ষ বকেয়া বিলের কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তখন তাদের কিছু করার উপায় থাকবে না। এতে কর্মক্ষম শ্রমিক বেকার হবে, রফতানি আয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের রাস্তা সঙ্কোচিত হয়ে পড়বে। যার সার্বিক প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে। তিনি দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারককে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, চলমান সঙ্কটের মধ্যে কী কারণে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ বাড়ানো হলো তা বোধগম্য নয়। তিনি জানান, এমনিতেই গত ৬ মাস যাবত এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছে না, এর আগে বিদ্যুৎ স্বল্পতা ছিল, এরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো এতে এ খাতের শিল্পগুলোতে এমনিতেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এর ওপর গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানোর কারণে প্রতি টন রডের উৎপাদন খরচ বিদ্যুৎ গ্যাস মিলে দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। এখন যেখানে প্রতি টন রড উৎপাদন করতে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়, এখন তা দ্বিগুণ অর্থাৎ ২০ হাজার টাকা ছেড়ে যাবে। এর ফলে গ্রাহক পর্যায়ে বাড়বে আরো বেশি। এতো দাম দিয়ে আমাদের দেশের মানুষের বাড়ি-ঘর নির্মাণ করার সক্ষমতা আছে কী না তা ভাবার বিষয়। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানোর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে। এর ফলে বাড়বে বিদ্যুতের দাম। এমনি পরিস্থিতিতে এ শিল্প টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়বে। আর তা হলে এ শিল্পের সাথে জড়িত লাখ লাখ কর্মক্ষম শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।

বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং ফার সিরামিকসের পরিচালক ইরফান উদ্দিন গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, এমনিতেই ডলার সঙ্কটের কারণে সময়মতো কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। ডলারের দামও বেড়ে গেছে। এর ফলে কাঁচামালের আমদানি ব্যয়ও অনেক বেড়ে গেছে। এরপর গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সিরামিকস শিল্পে বড় ধরনের আঘাত আসবে। তিনি বলেন, সামনে এ আঘাত আরো বেশি করে আসবে, কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। আর এতে সামনে বিদ্যুতের দামও অস্বাভাবিক হারে বাড়বে। তিনি মনে করেন, সিরামিক শিল্পের নেতিবাচক প্রভাব বড় আকারে দেখা দেবে। তিনি বলেন, গ্যাস সিরামিক শিল্পের কাঁচামালের অন্যতম প্রধান উপকরণ। সিরামিক পণ্যের মোট উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় ১২ শতাংশ যায় এই গ্যাসের পেছনে। কিন্তু গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি পেলেও তৈরি করা পণ্যের মূল্য ইচ্ছামতো বাড়ানো যায় না। ফলে উৎপাদকেরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। তিনি পরিসংখ্যান টেনে বলেন, ২০১৯ সালে শিল্প খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য প্রায় ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তখনই সিরামিক পণ্যের গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০ থেকে ১২ শতাংশ। ২০২২ সালে দুই দফায় আরো প্রায় ৪০ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। এখন নতুন করে প্রায় দ্বিগুণ দাম বৃদ্ধি আমাদের মহাবিপদে ফেলে দিচ্ছে। এর ফলে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সার্ভাইভ করা কঠিন হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গত ছয় মাসে কাঁচমালের দাম কমপক্ষে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। ডলার কারণে আরো ৩০ শতাংশ বেড়েছে। লোকাল মার্কেটে বিক্রিতে ডেলিভারি চার্জ, মার্কেটিং কস্ট, লেবারদের কষ্টও বেড়েছে। তবে পণ্যের দাম বাড়েনি। ফলে ভবিষ্যতে রিকভারির আশায় লোকসান দিয়ে টিকে আছি। দেশে এখন ৭০টি সিরামিক কারখানা (টেবিলওয়্যার, টাইলস ও স্যানিটারি ওয়্যার) আছে। এসব কোম্পানিতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আছে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, সিরামক পণ্যের স্থানীয় বাজারে ১০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। আর প্রতি বছর রফতানি আয় হয় প্রায় ৪০০ কোটি টাকার পণ্য। সরকারকে রাজস্ব দেয় প্রায় তিন হাজার কোটি আর গ্যাস বিল দেয় প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ও নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ না হলে নতুন কর্মসংস্থান তো হবেই না, উল্টো শ্রমিক ছাঁটাই করতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/721739