২০ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ১০:৩৯

গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতির খড়গ সাধারণ মানুষের ঘাড়েগ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতির খড়গ সাধারণ মানুষের ঘাড়ে

গ্যাস-বিদ্যুৎ আর নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতির খড়গ চাপছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। শিল্প গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে নড়েচড়ে বসছেন দেশের শিল্পদ্যোক্তারা। উৎপাদন ব্যয় বাড়ার হিসাব কষার পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির শঙ্কায় ভোক্তা-ব্যবসায়ীরা। যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে চড়া পণ্যমূল্যে এমনিতেই ধুঁকছেন দেশের ভোক্তারা। এরমধ্যে নতুন করে প্রতি ইউনিটে প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি আর শিল্প গ্যাসের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৯৮ টাকা। জীবনযাত্রায় ব্যয়ের বোঝা আরও বাড়ছে।

জ্বালানি বিভাগের ঘোষণা অনুযায়ী বড় শিল্পখাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। অন্যদিকে শিল্পগুলোর নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ইউনিট প্রতি গ্যাসের দাম ৩০টাকা করা হয়েছে যা আগে ছিলো ১৬ টাকা।

আবার মাঝারি শিল্পে গ্যাসের দাম ছিলো ১১ টাকা ৭৮ পয়সা আর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ছিলো ১০ টাকা ৭৮ পয়সা। এখন উভয় খাতকেই ইউনিট প্রতি গ্যাসের দাম ৩০ টাকা করে দিতে হবে। এছাড়া হোটেল ও রেস্তোরাঁ খাতে ২৬ টাকা ৬৪ পয়সার জায়গায় সামনের মাস থেকে দিতে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ হোটেল-রেস্তোরাঁ ছাড়া প্রতিটি খাতেই দুই থেকে তিনগুণ পর্যন্ত গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার।

সংকটে ডলারের দাম চড়তে থাকার মধ্যে ২০২২ সালের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ধাক্কার রেশ কাটিয়ে ওঠার আগেই এ পদক্ষেপ মানুষকে আরও চাপে ফেলবে, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তাদের ভয়। এমন প্রেক্ষাপটে আবার মূল্য বাড়ানোর দিকে না গিয়ে বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলোর স্তরে স্তরে চলা চুরি, অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অপচয় সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়েছেন সংক্ষুব্ধদের কেউ কেউ।

গত ডিসেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা করে বিইআরসি। তখন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, পাইকারিতে বাড়লেও খুচরায় দাম বাড়বে না, ফলে জনজীবনে প্রভাব পড়বে না।

তবে ওই ঘোষণার এক মাসের মধ্যে বিতরণ কোম্পানিগুলো খুচরায় দাম বাড়াতে একে একে আবেদন করতে শুরু করে। এসব কোম্পানির প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে বিইআরসির কারিগরি কমিটিও দাম বাড়ানোর সুপারিশই করে।

এদিকে সরকারও ইতোমধ্যে আইন সংশোধন করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির কাছ থেকে নিজেদের কাছে নেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে। সেই প্রক্রিয়া চলমান থাকার মধ্যে ভোক্তা মহলের বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য বাড়ানোর পথে হাঁটছে কমিশন।

বিদ্যুতের দাম বাড়াতে রেগুলেটরি কমিশনের উদ্যোগ প্রসঙ্গে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমই এর সভাপতি ফারুক হাসান মনে করছেন এতে রপ্তানি শিল্প যেমন প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে, দেশে শিল্প উৎপাদনও ব্যয়বহুল হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। এর সঙ্গে দেশে মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে, সে অনুযায়ী ব্যাংক ঋণে সুদহারও বেড়েছে। সুদহার বাড়ার কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারেও পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এর সঙ্গে নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়লে তা জনজীবনের সর্বত্র মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে।

আমি মনে করি বিদ্যুৎখাতে নানা ধরনের সিস্টেম লস রয়ে গেছে। সিস্টেম লস মানে কিন্তু অনেক কিছু। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ চুরি হয়, মিটার রিডিং থেকে শুরু করে সর্বত্র চুরির একটা প্রবণতা আছে। এখনও অনেক অবৈধ সংযোগ আছে। যত অবৈধ কানেকশন আছে, সেটা যদি আমারও থাকে, আমি মনে করি সেটা কেটে দেওয়া উচিত।
বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হলেও অন্তত ছয় মাস অপেক্ষা করা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, আগামী ছয় মাসের মন্দা বিবেচনা করে মানুষের ব্যয় আর যাতে না বাড়ে সে চেষ্টা করা উচিত। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার অর্থ হচ্ছে তৃণমূলের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী সবার ওপরেই সেই প্রভাব পড়বে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে ২০২৩ সালের মূল্যস্ফীতিকে তা উসকে দেবে। বিদ্যুৎ খাতের সিস্টেম লস, অনিয়ম বন্ধ করলে সরকার বিতরণ কোম্পানিগুলোর ওপর আসা বাড়তি আট হাজার কোটি টাকার চাপ সামাল দিতে পারবে।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ক্ষত না শুকাতেই আবার বাড়লো শিল্প গ্যাসের দাম। এতে করে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ছে। এই মূল্যস্ফীতি প্রতিনিয়ত ভোক্তাকে তাড়া করছে।
সরকার গত কয়েক অর্থবছর ৫ শতাংশের কিছু বেশি হারে মূল্যস্ফীতি হিসাব করে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করছে। অথচ গত চার মাস ধরে ৮ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। এক দশকের রেকর্ড ভেঙে গত আগস্টে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়। এরপর তা নিম্নমুখী হলেও ডিসেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়াতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে ভোগান্তি বাড়বে, মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। আর শিল্প গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে সব ধরনের সেবা পণ্যের দাম বাড়ছে।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে শঙ্কার কথা জানান পোশাক রপ্তানিকারকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএ এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও। তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম ভোক্তাপর্যায়ে বাড়লে শিল্পখাতে বাড়বে না বলে মন্ত্রী বলেছিলেন। কিন্তু গত বুধবার সরকার শিল্প গ্যাসের দামও বৃদ্ধি করলো। এতে করে উৎপাদন পর্যায়ে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। যা ভোক্তা পর্যায়ে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে করে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ছে। আর এতে শঙ্কিত ভোক্তারা।

https://dailysangram.com/post/514207