আওয়ামী লীগ সবকিছুর মধ্যে সবসময় একটা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার করে এবং অবিরাম তা প্রচার করে। আওয়ামী লীগের আরো একটা সুবিধা হলো এর কর্মিরা সত্যাসত্য বিবেচনা না করে ঐ সব তত্ত্বের প্রতি ঢালাও সমর্থন দিয়ে চিল্লা পাল্লা করতে থাকে। যেমন এখন চালু কথা হলো বিএনপি নির্বাচন নিয়ে চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র করছে। এ কথা যদি টেকনাফের আওয়ামী লীগারের মুখে শুনেন তাহলে আপনি ধরে নিতে পারেন যে, তেঁতুলিয়ার আওয়ামী লীগ কর্মীর মুখেও আপনি ঐ ষড়যন্ত্রের কথা শুনতে পাবেন। কিন্তু তারা কেউ জানে না যে, প্রকৃত পক্ষে ঐ চক্রান্ত ব্যাপারটা কী। কিন্তু বলে যেতেই থাকে।
তবে সম্প্রতি বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের বক্তব্য নিয়ে সরকার বড় বেকায়দায় আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশে^র যে কোন দেশের কূটনীতিকের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করছেন। বলছেন, তাদের যা খুশি বলতে দাও আমরা আমাদের মতো কাজ করবো। এই বক্তব্য শুধু প্রধানমন্ত্রীর নয় এ বক্তব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী এমন সব ব্যক্তি অবিরাম এসব কথা বলছেন। কখনো কখনো মনে হয় এই বুঝি সরকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশ থেকে বের করে দিলো। কিন্তু মার্কিন বা জাপানি, জার্মানি বা সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশে গুম খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অবিরাম তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে সবচেয়ে সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্র। এ কথার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিনা প্রমাণে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলে বসলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ৬ লক্ষ মানুষ গুম হয়। বিষয়টা এতোটাই হাস্যকর ছিলো যে, তার দুদিনের মাথায়ই ঐ একই মন্ত্রী বললেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর দেড় লক্ষ মানুষ গুম হয়। স্কুলের ভিতরে ঢুকে শিশুদের খুন করতে দ্বিধা করে না। তাদের আবার এতো গর্ব কিসের! এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ঢং। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যাস হয়ে গেছে অপর রাষ্ট্রের বিষয়ে মাতাব্বরি করা। এমনি সব শব্দবাণ বর্ষণ করে যাচ্ছিল বাংলাদেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলো যখন একযোগে বলতে থাকলো যে, গুম খুন ও মানবাধিকার বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের পক্ষে তারা কথা বলেই যাবে। বাংলাদেশে অবশ্যই সুষ্ঠু নিরপেক্ষ স্বচ্ছ এবং সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে।
এর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেলো। গত ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস শাহীনবাগে গুম হওয়া এক পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তার ওপর হামলার চেষ্টা করা হয়। এটা যে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বিরোধী সেটা অনুধাবন করার ক্ষমতা এই সরকারের কোন মন্ত্রী মিনিস্টারের নেই। সে কারণে তারা লাফালাফি করতে থাকে। ঐ ঘটনার পর ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতকে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরে ডেকে পাঠায় এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ তার নাগরিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি জানায়। এদিকে জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, পৃথিবীর কোথাও দিনের ভোট রাতে হয় এবং পুলিশ দিয়ে ভোটের বাক্স ভরিয়ে রাখা হয় এমন কথা তিনি কখনো শুনেননি। তা নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বললেন, এই ঘটনায় জাপানি রাষ্ট্রদূতকে ডেকে যা বলার বলে দিয়েছি। কিন্তু জাপানি দূতাবাস থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে জাপানি রাষ্ট্রদূতের কোন দেখাই হয়নি। সরকার তার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রমাণের জন্য ডাহা মিথ্যা কথা বলতে শুরু করে।
এর আগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের কর্মরত ও সাবেক ৬ কর্মকর্তা এবং র্যাব বাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধেও একই রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তখন সরকারকে নড়ে চড়ে বসতে হয় বৈকি। সরকার মুখে নানা হোম্বি তোম্বি করলেও এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যাপারে বিপুল অর্থ ব্যয়ে লবিস্ট নিয়োগ করে এই সিদ্ধান্তের পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। সরকারের বক্তব্য হলো বিএনপি জামায়াত বিপুল অর্থ ব্যয় করে লবিস্ট দিয়ে এই নিষেধাজ্ঞা আনিয়েছে। এরকম সময়ে প্রধানমন্ত্রী ওয়াশিংটনে আওয়ামী কর্মীদের উদ্দেশে ঐ সব ‘অপকর্মে’ লিপ্ত ব্যক্তিদের হাত ভেঙ্গে দেয়ার জন্য তার নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। এই ঘোষণায় পশ্চিমাদের মনে আরেক দফা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পিটার হাসের ওপর হামলার ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ছিলো খুবই শিশুসুলভ এবং তাতে তার ঝগড়াটে মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের হোম্বি তোম্বিতে কোন কিছুই থেমে থাকে নি। পশ্চিমা বিশ^ তাদের অবস্থানে অনড় থাকে।
এদিকে পিটার হাসের ওপর হামলার ঘটনায় রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে জানান যে, পিটার হাসের গুম পরিবারের সঙ্গে দেখা করা ছিলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ। মুখপাত্র জাখারোভা এই বক্তব্য দেয়ার পর সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠে যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা কি তবে সেদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ নয়। জাখারোভা বলেন, পিটার হাসের ওপর হামলার চেষ্টা ছিলো স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। রাশিয়া বলতে চেয়েছে পিটার হাসের একজন বিএনপি নেতার বসায় যাওয়া ঠিক হয়নি। রাশিয়ান এই টুকু মদত পেয়ে ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের মন্ত্রীরা বলতে থাকেন যে, যেদিন পিটার হাস শাহীনবাগে ঐ গুম নেতার বাসায় গিয়েছিলেন সেদিন ছিলো শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। পিটার হাস কেন শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে না গিয়ে বিএনপির গুম নেতা সাজেদুল ইসলামের বাসায় গেলেন। ওবায়দুল কাদের আরো বললেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে কতজন গুম হয়, কতজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়, কতজন খুন হয়, সেই চিত্র কিন্তু সিএনএনে আমরা দেখেছি। এই বিষয়ে সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী কিছু সুশীলও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়ে বসলো।
কিন্তু বাংলাদেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে অনড়ও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এবার একথাওতো সত্য একজন রাষ্ট্রদূত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে যাবেন নাকি কোন গুম হওয়া পারিবারকে সান্ত¡না দিতে যাবেন সেটাও কি সরকার ডিকটেট করবে? সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সকালে কী বলেন আর বিকালে কী বলেন সেটা বোঝা মুশকিল। কখনো কখনো তিনি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরেও চলে যান। এর পরিণতি কী হতে পারে সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। পর্দার অন্তরালেও অনেক কিছু ঘটে।
আওয়ামী মন্ত্রীরা যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নানা কথায় লিপ্ত তখন যুক্তরাষ্ট্র তার করণীয় বিষয়ে নিজস্ব মনভাবে অটুট থাকেন। এর আগে ইকবাল রোডে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের বাসায় নৈশভোজে গিয়েছিলেন আরেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। সেখানে তার ওপর রীতিমত হামলা হয়। তারা বদিউল আলম মজুমদারের বাড়িঘর ভাঙচুর করে এবং অল্পের জন্য অক্ষত অবস্থায় ফিরেছিলেন বার্নিকাট। এনিয়ে মামলাও হয়েছিলো। তাতে নয় জন আওয়ামী লীগারকে আসামী করে মামলা করা হয়েছিলো। সেই মামলার আসামীর তালিকা থেকে বাদ দেয়ে হয়েছিলো প্রধান আসামীকে। কিন্তু পিটার হাসের ওপর হামলার পর আদালত থেকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। এবারে প্রধান আসামীকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।
সরকারের তরফ থেকে যে যাই বলুক যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থানে অটুট রয়েছে। ইতিপূর্বে র্যাবের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র সেটি তুলে নেয়ার জন্যে নিজেরাতো লবিস্ট নিয়োগ করেছেই একই সঙ্গে ভারতকে অনুরোধ করেছে তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রকে বিষয়টা বোঝায় এবং ঐ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে সহায়তা করে। অর্থাৎ নিজ মেরুদন্ডের উপর দাঁড়াবার ক্ষমতা আওয়ামী লীগ সরকারের নেই।
সেকারণে আমরা দেখলাম রাশিয়ার স্পার্টা-৩ জাহাজটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। রাশিয়া সেই জাহাজেরই নাম ও রং পরিবর্তন করে ঐ জাহাজেই রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের মাল সামান বাংলাদেশে পাঠাবার চেষ্টা করে। কিন্তু জাহাজটি বাংলাদেশ জলসীমায় প্রবেশের আগেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে এই বলে সর্তক করে যে, জাহাজটিকে যদি বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে দেয়া হয় কিংবা তাতে যদি খাদ্য বা জ¦ালানি সরবরাহ করা হয় তবে যুক্তরাষ্ট্র কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। একথা বাংলাদেশকে কূটনৈতিক সূত্রে জানায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু রাশিয়া ঐ জাহাজ বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
এদিকে অধিকতর অবরোধ এড়াতে বাংলাদেশ সরকার জাহাজটিকে আর বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করতে দেয়নি। তাহলে কোথায় গেলো মোমেনের জারি জুরি। ঝট করে তিনি সুর বদলালেন। বললেন, আমাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিরাট বাণিজ্য। ফলে কথা ঘুরাতেই হলো। এক্ষেত্রেও সরকার বারবার বলেছে যে, বিএনপি কোটি কোটি ডলার খরচ করে র্যাবের ওপর ঐ নিষেধাজ্ঞা আনিয়েছিলো। এগুলো ধোপে টিকেনি। কিন্তু তাকে কী। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখনো জারি আছে।