১৯ জানুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১০:৫১

ব্যাগ কাঁধে ঘুরে ঘুরে ডলার ব্যবসা

অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিতে দিনে গড়ে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রার লেনদেন হয়। এই হিসাবে দেশের ১ হাজারের মতো অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জে ৭০০ থেকে ৭৫০ কোটি টাকার মতো লেনদেন হয়। বৈধ-অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বাইরেও ভ্রাম্যমাণ কিছু ব্যবসায়ী রয়েছে। যারা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ঘুরে ঘুরে অবৈধভাবে বেচা-কেনা করছে দেশি-বিদেশি মুদ্রা। এই হিসাবে লেনদেনের পরিমাণ আরও বেশি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল সিআইডি’র প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিয়ে দেশে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসা পরিচালনা করছে ২৩৫টি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে হাজারেরও বেশি মানি এক্সচেঞ্জ। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিতে দিনে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টাকার লেনদেন হয়।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। ফলে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি বিরাজমান।

বাংলাদেশও এর অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের কিছু অসাধু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসায়ী লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এবং অধিক মুনাফার জন্য মার্কিন ডলার মজুত করে দাম বাড়াচ্ছে। ৮৫ টাকার ডলার ১২৩ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এ কাজে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের চেঞ্জারের যেমন ভূমিকা ছিল তেমনি কিছু কিছু বৈধমানি এক্সচেঞ্জারের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ডলারের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় সিআইডি বেশকিছু অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে।

এরই প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর তিনটি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ অফিসসহ দুটি ফেরারি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় সিআইডি। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- গুলশানের জে এম সি এইচ প্রাইভেট লিমিটেড, মোহাম্মদপুরের টোকিও স্কয়ারের আলম অ্যান্ড ব্রাদার্স এবং উত্তরার আশকোনা মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের তৈমুর মানি এক্সচেঞ্জ। বাকি দুটি ফেরারি প্রতিষ্ঠান। এ সময় মোট পাঁচ প্রতিষ্ঠানের ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হলো- আবু তালহা ওরফে তাহারত ইসলাম তোহা (৩২), আছাদুল শেখ (৩২), হাছান মোল্যা (১৯), আব্দুল কুদ্দুস (২৪), হাসনাত এ চৌধুরী (৪৬), শামসুল হুদা চৌধুরী ওরফে রিপন (৪০), সুমন মিয়া (৩০), তপন কুমার দাস (৪৫), আব্দুল কুদ্দুস (৩২), কামরুজ্জামান রাসেল (৩৭), মনিরুজ্জামান (৪০), নেওয়াজ বিশ্বাস, আবুল হাসনাত (৪০) ও শাহজাহান সরকার (৪৫)।

সিআইডি প্রধান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ টিমের তথ্য ও সহযোগিতায় রাজধানীর গুলশান-১, রিংরোড, মোহাম্মদপুর, উত্তরার আশকোনা, এবি মার্কেট, চায়না মার্কেটে একযোগে পাঁচজন বিশেষ পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকায় অবৈধ। অভিযানে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রাসহ মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় আসামিদের কাছ থেকে ১ কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার ৮২৬ টাকা সমমূল্যের ১৯টি দেশের বৈদেশিক মুদ্রাসহ সর্বমোট ১ কোটি ৯৯ লাখ ৬১ হাজার ৩৭৬ টাকা জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিজস্ব অফিস এবং ভ্রাম্যমাণ যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি (লাইসেন্স) ব্যতীত বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করে আসছিল। প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় পরিচালিত অবৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের নেপথ্যে যারাই থাকুক তাদের খুঁজে বের করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসায়ীরা অর্থ পাচার বা হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিনা? জবাবে তিনি বলেন, অল্প সময়ে স্বল্প পুঁজিতে বেশি আয়ের আশায় অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জগুলো তৈরি হচ্ছে। অভিযানে অবৈধ ৫টি মানি এক্সচেঞ্জের মধ্যে তিনটির অফিস থাকলেও বাকি দুটো প্রতারণামূলক বা ফেরারি। তারা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মানি এক্সচেঞ্জ করতেন। ফোনে ফোনে যোগাযোগ করলেই যদি একজন টাকা বা বিদেশি মুদ্রা বা ডলার পেয়ে যায়, তাহলে সে কেন ব্যাংকে যাবে? যদিও প্রক্রিয়াটা অবৈধ। এক্ষেত্রে ব্যাংকের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা প্রবাসী তারা দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাসায় বসেই টাকা পাঠায়। এক্ষেত্রে সময় বাঁচে ও কোনো হয়রানি বা বাড়তি কোনো ভাড়া লাগে না। দেশের মানুষ ঘরে বসে টাকা পেয়ে যায়। তবে এটা অবৈধ।

অবৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের জ্ঞাতসারেই হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর কোনো গাফিলতি রয়েছে কিনা?- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। তবে আমাদের দেশের স্বার্থে কষ্ট করতে হবে। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার মতে, কোনো অবৈধ পথ বেছে নেয়া উচিত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য যেকোনো ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা যদি হুন্ডি কিংবা অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে জড়ানোর তথ্য মেলে তবে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

https://mzamin.com/news.php?news=39048