১৯ জানুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৭

শিল্প খাতে গ্যাসের দাম পৌনে ২০০ ভাগ বৃদ্ধি

পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ের সাথে চাপ বাড়বে শিল্প কারখানায়

সব ধরনের শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে ক্ষুদ্র শিল্পে ১৭৮.২৯ শতাংশ, মাঝারি শিল্পে ১৫৪.৬৭ ও বৃহৎ শিল্পে ১৫৪.৪২ শতাংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে ১৭৮.৮৮ শতাংশ। সরকারের নির্বাহী আদেশে এ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এ মাসে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছিল। গতকাল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। নতুন এ দাম আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানোকে শিল্পোদ্যোক্তারা তাদের ওপর বড় ধরনের ঝড় বয়ে যাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। তারা মনে করছেন, এর ফলে অনেক ছোট শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। বড় শিল্পগুলোও বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, এমনিতেই তারা সঙ্কটের মধ্যে আছেন, এরওপর এ ধরনের দাম বাড়ানোর ফলে তাদের উৎপাদনব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। যে হারে দাম বাড়বে ওই হারে বিদেশী ক্রেতারা তাদের দাম দেবেন না। এতে রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে পণ্যের উৎপাদনব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির বড় ধরনের ধাক্কা আসবে গ্রাহকের ওপর।

বিদ্যুতের পর এবার এলো গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা। একই মাসে দু’টিই হয়েছে সরকারের নির্বাহী আদেশে। এবার শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে।

গতকাল নির্বাহী আদেশে বাড়া বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ থেকে দেয়া এক প্রজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, সরকারি- বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বর্তমান ৫ টাকা ২ পয়সা ছিল। এ থেকে ১৭৮.৮৮ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১৪ টাকা করা হয়েছে। সব ধরনের শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। যেমন, বৃহৎ শিল্পে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ছিল ১১ টাকা ৯৮ পয়সা। এ থেকে ১৫০.৪২ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। মাঝারি শিল্পের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ছিল ১১ টাকা ৭৮ পয়সা। সেখান থেকে ১৫৪.৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ক্ষুদ্র শিল্পে। এ খাতে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ছিল ১০ টাকা ৭৮ পয়সা। সেখান থেকে ১৭৮.২৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে।

বড় শিল্পোদ্যোক্তারা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য নিজেরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এ ক্যাপটিভ পাওয়ারে ব্যবহৃত গ্যাসের দামে সাড়ে ৮৭ শতাংশ বাড়িয়ে ১৬ টাকা থেকে ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সাথে হোটেল রেস্তোরাঁয় ব্যবহৃত গ্যাসের দামও ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগে প্রতি ঘনমিটারের দাম ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে সাড়ে ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

তবে আবাসিক, সিএনজি, চা শিল্প ও সার-কারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। আবাসিক গ্রাহকদের এক চুলার ক্ষেত্রে আগের মতো ৯৯০ টাকা এবং দুই চুলার ক্ষেত্রে ১০৮০ টাকা বিল রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি সিএনজিতেও প্রতি ঘনমিটার ৪৩ টাকা এবং চা শিল্পের গ্যাসের দামও আগের মতো প্রতি ঘনমিটার ১১ টাকা ৯৩ পয়সা এবং সার-কারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের দামও আগের মতো ১৬ টাকা রাখা হয়েছে।

শিল্পে গ্যাসের দাম এ অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির বিষয়ে গতকাল বিকেএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে শামীম এহসান নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, শিল্পকারখানায় গ্যাসের এ দাম বৃদ্ধি তাদের ওপর রীতিমতো ঝড় বয়ে দেয়া হলো। কারণ এ দাম বৃদ্ধির কারণে শুধু জ্যাকেটে দাম বেড়ে যাবে ১০ থেকে ১৫ ডলার। কিন্তু বিদেশী ক্রেতাদেরকে এক ডলারও দাম বাড়ানো যাবে না। কারণ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমনিতেই ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের পোশাকের দাম বাড়ায়নি। এই মুহূর্তে তাদের পোশাকের দাম বিদেশী ক্রেতারা বাড়াবে না। এতে রফতানি আয়ের ওপর বড় ধরনের বিপর্যয় আসতে পারে। আর এর ফলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের যে লোকসান হবে তা ছোট বড় বেশির ভাগ শিল্পকারখানাই সমন্বয় করতে পারবে না। ঝড়ে যেমন ছোট ছোট গ্যাস পড়ে যায়, তেমিন এ দাম বাড়ানোর ঝড়ে ছোট শিল্পকারখানা ধকল সামলাতে পারবে না। তাদেরকে বন্ধ করে দেয়া ছাড়া সামনে আর কোনো উপায় থাকবে না। একই সাথে মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোও টিকে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়বে। বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বড় শিল্পকারখানা। তিনি জানান, এমনিতেই তারা মাইনাসে। বেশির ভাগ শিল্পকারখানায় আর ওভারটাইম করানো হয় না। এরওপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরে অস্বাভাবিক হারে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় রফতানিমুখী শিল্পে যে ক্ষতি হবে তা সামাল দেয়া কষ্ট হবে। তিনি এ অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ করেন সরকারের কাছে।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেষ মাসাদুল আলম মাসুদ এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, চলমান সঙ্কটের মধ্যে কী কারণে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ বাড়ানো হলো তা বোধগম্য নয়। তিনি জানান, এমনিতেই গত ছয় মাস ধরে এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছে না, এর আগে বিদ্যুৎ স্বল্পতা ছিল, এরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো এতে এ খাতের শিল্পগুলোতে এমনিতেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এর ওপর গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানোর কারণে প্রতি টন রডের উৎপাদন খরচ বিদ্যুৎ গ্যাস মিলে দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। এখন যেখানে প্রতি টন রড উৎপাদন করতে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়, এখন তা দ্বিগুণ অর্থাৎ ২০ হাজার টাকা ছেড়ে যাবে। এর ফলে গ্রাহক পর্যায়ে বাড়বে আরো বেশি। এত দাম দিয়ে আমাদের দেশের মানুষের বাড়ি-ঘর নির্মাণ করার সক্ষমতা আছে কি না তা ভাবার বিষয়। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানোর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে। এর ফলে বাড়বে বিদ্যুতের দাম। এমনি পরিস্থিতিতে এ শিল্প টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়বে। আর তা হলে এ শিল্পের সাথে জড়িত লাখ লাখ কর্মক্ষম শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/721495