১৮ জানুয়ারি ২০২৩, বুধবার, ১১:১৮

বহুমুখী শর্তে বাড়বে মূল্যস্ফীতির চাপ

অর্থনৈতিক ভারসাম্যে সাময়িক স্বস্তি মিলবে

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ দিতে বহুমুখী শর্ত আরোপ করেছে। এর মধ্যে প্রধান শর্ত হচ্ছে ভর্তুকি কমানো। ভর্তুকি কমালে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম বাড়াতে হবে। এতে সরকারের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য ফিরবে। কিন্তু এর বিপরীতে পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতির হারে বাড়তি চাপ পড়বে। এতে ভোক্তার কষ্ট বাড়বে। তাদের শর্তে দ্রুত সংস্কার বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতিতে সুফল মিলবে। কিন্তু সংস্থাটি ভর্তুকি কমাতে যে চাপ দিচ্ছে, সেভাবে সংস্কার বাস্তবায়নে চাপ দিচ্ছে না। ফলে অর্থনীতিতে আইএমএফ’র সংস্কারের সুফলও দ্রুত মিলবে না। সংস্থাটির অন্যান্য শর্তের মধ্যে আছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ কমানো, ডলারের বিপরীতে টাকার মান পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি।

সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় সরকার আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে। এ ঋণের ব্যাপারে ইতোমধ্যে দুপক্ষের সমঝোতা হয়েছে। এর আওতায় অচিরেই একটি চুক্তি হবে। এরপরই ঋণ প্রস্তাবটি ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ’র নির্বাহী বোর্ডের সভায় উপস্থাপন করা হবে। ওই সভায় ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন হবে বলে ইতোমধ্যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এটি অনুমোদন হলেই ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় করার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার পাওয়া যাবে। পরবর্তী কিস্তিগুলো ৬ মাস পরপর পাওয়া যাবে। এভাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে ঋণের শেষ কিস্তি মিলবে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফ’র সব শর্ত বাস্তবায়ন করলে অর্থনীতিতে একটি শৃঙ্খলা ফিরে আসতে পারে। তখন মূল্যস্ফীতির হারও কমবে। কিন্তু সরকার অর্ধেক বাস্তবায়ন করলে, আর অর্ধেক না করলে কিছুই হবে না। ভর্তুকি কমানোর কারণে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়বে। আবার সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে দুর্নীতি কমানো ও ব্যয় সাশ্রয় সম্ভব হলে ধীরে ধীরে চাপ কমে আসবে। তবে আইএমএফ’র ঋণ দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে চাপ মোকাবিলা করা যাবে না। তবে কিছুটা কমানো যাবে। সরকারকে ব্যয় সাশ্রয়ী হতে হবে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। কারণ দীর্ঘ সময় আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হলে দেশের বাজারে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। শিল্প খাতেও সংকট বাড়বে।

সূত্র জানায়, ঋণ ছাড়ের জন্য আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়নে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করতেই সংস্থাটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত এম সায়েহ এখন ঢাকা সফর করছেন। তিনি ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে ঋণের শর্তগুলো বাস্তবায়নে দুপক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে। কিছু শর্ত কত দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে সেগুলোও সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত আইএমএফ’র একটি মিশন বাংলাদেশ সফর করে শর্তের বিষয়গুলো চূড়ান্ত করে গেছে। কিন্তু তারা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে শর্ত বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারেনি। যে কারণে এবার সংস্থাটির ডিএমডি ঢাকায় এসে সে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছেন। এর আগে আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে ঢাকা আসতে হয়নি। প্রচলিত মিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। কিন্তু করোনার সময় ঋণের প্রথম দফা নিয়ে দ্বিতীয় দফা নেওয়ার আগে শর্তের বাস্তবায়ন করেনি বলে আইএমএফও ঋণ দেয়নি। সরকারও নেয়নি। কারণ ওই সময়ে সরকারের ঋণের প্রয়োজন ছিল না। ওই অভিজ্ঞতা থেকে এবার আইএমএফ শর্ত বাস্তবায়নে রাজনৈতিক অঙ্গীকার আদায় করেছে। তবে শর্ত আরোপের ক্ষেত্রে এবার আইএমএফ বেশ শিথিলতা দেখিয়েছে।

আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশে আরও সময় নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেননা এখন রিজার্ভ নিম্মমুখী। এটি কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হলেই রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করা হবে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে পর্যায়ক্রমে। এখনো পুরোপুরি বাজারের ওপর ছাড়া হয়নি। নেপথ্যে থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের ওপর হস্তক্ষেপ করছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল রাখার জন্য তারা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ডলার বেচাকেনা অব্যাহত রাখবে।

আন্তর্জাতিক রীতি মেনেই এটি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেননা এটি না করলে বাজারে ডলারের দাম হঠাৎ করে বেশি ওঠানামা করবে। আইএমএফ’র শর্তের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণও কমিয়ে আনা হবে। এ জন্য সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। এই মার্কেট থেকে সরকার প্রতিযোগিতামূলক সুদ হারে ঋণ নেবে। এই বাজার থেকে সরকার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি করপোরেট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকেও ঋণ নিতে পারবে। এছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাড়ানো বা কমানোর কাঠামো তৈরি করতে আরও সময় চেয়েছে সরকার। আইএমএফও এসব খাতে সময় দিয়েছে।

তবে এগুলো দ্রুত সম্পন্ন করাই ভালো বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। তাদের মতে, এসব শর্ত বাস্তবায়ন হলে সরকারের ঋণ গ্রহণের চাপ কমে যাবে। এতে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ও মুদ্রানীতিতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তারা চলতি বছরের মধ্যেই এসব পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার শর্ত দিয়েছে। কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানোর জন্য আগে আইএমএফ চাপ দিলেও এবার দিচ্ছে না। মন্দা মোকাবিলায় তারা বরং কৃষি খাতকে উৎসাহিত করছে। তারপরও সরকার ইতোমধ্যে সারের দাম বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে কৃষি ব্যবহৃত জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে।

সূত্র জানায়, আইএমএফ এবার মূলত ভর্তুকি কমানোর ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তাদের শর্তের কারণে ইতোমধ্যে জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার ও দরিদ্রদের জন্য বিতরণ করা খাদ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার সিন্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুতের দাম প্রতি মাসে সমন্বয় করা হবে। গ্যাসের দাম আরও এক দফা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে। এসব সেবার দাম বাড়ানো হলে গণপরিবহণ, শিল্প ও কৃষি উৎপাদন খরচ বাড়বে। এর প্রভাবে বাড়বে পণ্যমূল্য। এতে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হারে বাড়তি চাপ পড়বে।

ডলার সংকট মোকাবিলায় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়া হলেও বাস্তবে তাতে খুব বেশি সুফল মিলবে না। কারণ, আইএমএফ থেকে ৬ মাস পরপর মিলবে ৬০ কোটি ডলারের মতো। অথচ দেশে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রতি মাসে ঘাটতি হচ্ছে ১৫০ কোটি ডলারের বেশি। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় এ ঘাটতি কমেছে। কিন্তু আমদানি বাড়লে আবার ঘাটতি বেড়ে যাবে। ফলে ডলারের সংকট মোকাবিলা এ ঋণ দিয়ে সম্ভব হবে না। তবে আশার কথা হচ্ছে, আইএমএফ থেকে ঋণ নিলে অন্যান্য সংস্থা থেকেও ঋণ পাওয়া সহজ হবে।

আইএমএফ আর্থিক খাত, সরকারের হিসাব ব্যবস্থাপনা, ঋণের ব্যবস্থাপনা, মুদ্রানীতি, আমদানি ব্যয় এসব খাতে বড় ধরনের সংস্কারের শর্ত দিয়েছে। কিন্তু তারা ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে যে চাপ দিচ্ছে, সংস্কারের শর্ত বাস্তবায়নে তেমন চাপ দিচ্ছে না। ফলে সরকার সংস্কারের গতিকে ধীর করে ফলতে পারে। এতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সুফল মিলবে না। অথচ এসব খাতে সংস্কারের জন্য দেশের সুশীল সমাজ থেকেও দীর্ঘদিন ধরে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু সরকার করছে না।

আইএমএফ মনে করে, সরকার ভর্তুকি কমালে ঋণ গ্রহণ কমবে। তখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় চাপ কমে আসবে। এজন্য তারা রাজস্ব বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে। কিন্তু রাজস্ব আয় দ্রুত বাড়ানো সম্ভব নয়। ফলে ঋণ কমাতে ভর্তুকি কমানোকেই তারা দ্রুত পথ বলে মনে করছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/636005