১৭ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, ১:৩১

বকেয়া পাচ্ছেন না এক লাখ শ্রমিক

দেশজুড়ে চা শ্রমিকদের ১৯ দিনের কর্মবিরতি গত আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে প্রত্যাহার করা হয়। শ্রমিকরা ফিরে যান কাজে। তবে শ্রমিকরা বলছেন, মালিকদের কাছ থেকে তাঁরা এখনো ৩০২ কোটি টাকা বকেয়া (এরিয়ার) বেতন পাননি। পুরো বার্ষিক বোনাসও পাননি। দেশে স্থায়ী চা শ্রমিকের সংখ্যা এক লাখ।

৮ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বকেয়া বেতন ও বোনাসের দাবিতে ‘সাধারণ চা শ্রমিকবৃন্দ’ ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। পরে শ্রমিকরা ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি দেন। এ ছাড়া বকেয়া মজুরি পরিশোধের দাবিতে বাংলাদেল চা শ্রমিক ইউনিয়ন চা-বাগান মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে এবং প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সভাপতি মাকন লাল কর্মকার শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মালিকরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মজুরি বাড়ানো হয়েছে। বকেয়া মজুরির বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। এ জন্য আমরা বকেয়া পরিশোধের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছি।’

বিভিন্ন চা-বাগানের শ্রমিক, পঞ্চায়েত সভাপতি, চা শ্রমিক নেতা, চা-বাগানসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকার দাবি ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলায় ১৭০ টাকা মেনেই তাঁরা কাজে ফিরেছেন। সে সময় শিক্ষা, চিকিৎসা, ভূমি অধিকার, মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধিসহ অন্য দাবিগুলোর বিষয়ে আশ্বাস দেওয়া হয়। প্রায় চার মাস পার হলেও এসব বিষয়ে অগ্রগতি নেই।

জানা গেছে, মালিকপক্ষের সঙ্গে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সর্বশেষ দ্বি বার্ষিক চুক্তি করা হয়েছিল ২০১৯-২০ সালে। এরপর নানা টালবাহানায় ২০২১-২২ সালে নতুন চুক্তি করা হয়নি। গত বছরের আগস্টে চা শ্রমিকরা আন্দোলনে নামলে প্রধানমন্ত্রী ১৭০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করে দেন। এখন চা শ্রমিকদের দাবি, যেহেতু দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মেয়াদ ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে, সে ক্ষেত্রে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নতুন দৈনিক মজুরি কার্যকর হবে। সে হিসাবে তাঁরা ওই দিন থকে ৫০ টাকা করে এরিয়ার বিল পান। যুগ যুগ ধরে এ নিয়মেই চলে আসছে।

তাঁদের হিসাবে ৬০৪ দিনের এরিয়ার বিল বাবদ প্রত্যেক শ্রমিকের পাওনা ৩০ হাজার ২০০ টাকা করে। তাতে দেশের এক লাখ স্থায়ী শ্রমিক বাগান মালিকদের কাছে ৩০২ কোটি টাকা পান। এ ছাড়া দুই বছরে দুটি বোনাসের এরিয়ার বাবদ প্রতি শ্রমিকের পাওনা ৪৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
সিলেটের আলী বাহার চা-বাগানের শ্রমিক নেত্রী রিনা নায়েক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যে মজুরি ঠিক করে দিয়েছেন তা মেনেই আমরা কাজে যোগ দিয়েছি। আমাদের যে মজুরিগুলো বকেয়া আছে সেগুলোও তিনি মালিকপক্ষের কাছ থেকে আদায়ের ব্যবস্থা করবেন। এগুলো তো আমাদের শ্রমের টাকা।’
একই বাগানের পঞ্চায়েত সদস্য নমিতা লোহার বলেন, ‘আন্দোলনের সময় যে ১৫ দিন কাজে যাইনি সে সময়ের দৈনিক মজুরিও মালিকপক্ষ দেয়নি। নানা টালবাহানা করছে। আমরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চাই।’

এদিকে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি সব বাগান কার্যকর করলেও অনেক বাগান অস্থায়ী শ্রমিকদের মজুরি বাড়ায়নি। এ রকম অভিযোগ করেছেন ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মোমিনছড়া চা-বাগান ও ফেঞ্চুগঞ্জ-বিয়ানীবাজারের মধ্যবর্তী ঢালুছড়া চা-বাগানের শ্রমিকরা। তাঁরা বলছেন, নানা অজুহাতে অস্থায়ী শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।

মোমেনছড়া চা-বাগান পঞ্চায়েতের সভাপতি লিটন মৃধা কালের কণ্ঠের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘বাগানের স্থায়ী শ্রমিকদের ১৭০ টাকা করে দিলেও অস্থায়ী শ্রমিকদের ১২০ টাকা করেই দেওয়া হচ্ছে।’

অভিযোগ ঠিক নয় দাবি করে মোমেনছড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপক রেজওয়ান আহমদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা স্থায়ী শ্রমিকদের ১৭০ টাকা করে দিচ্ছি। কিন্তু অস্থায়ী শ্রমিকদের জন্য এ রকম কোনো নির্দেশনা আসেনি।’
এসব বিষয়ে চা-বাগান মালিকদের একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের নির্বাহী সদস্য তাহসীন আহমেদ চৌধুরীর মোবাইলে গত শনিবার ফোন দিলেও তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

সিলেট জেলা বারের সাবেক সভাপতি এমাদউল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যেহেতু ঘোষণাটা দিয়েছেন, সেটি অবশ্যই পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই হয়েছে। বাংলাদেশ চা সংসদের সঙ্গে আলোচনা করেই তিনি এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সে হিসেবে আগের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মেয়াদ শেষে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অতিরিক্ত ৫০ টাকা করে চা শ্রমিকরা পাবেন।’

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এরিয়ার নিয়ে আমরা বিভিন্ন জায়গায় কথা বলে যাচ্ছি। শ্রম অধিদপ্তর বলছে, তারা মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছে। মালিকরা এত টাকা দেবেন না। বাগান বন্ধ হয়ে যাবে। টাকা একটু কমাতে হবে। কিন্তু এটা তো আমাদের প্রাপ্য।’ গত ২৮ ডিসেম্বর সর্বশেষ সভার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘শেষ সভায় আমরা এরিয়ারের বিষয় তুলেছিলাম। মালিকরা সরাসরি বলেননি। তাঁদের পক্ষে শ্রম দপ্তরের মহাপরিচালক ৫০ টাকার বদলে ১৬ টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। এখন দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করছেন।’ চুক্তি না হওয়ায় দুই বছরের দুটি উৎসব ভাতার এরিয়ারও বাকি আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের সময় শ্রমিকরা কাজে না গেলেও তাদের দৈনিক মজুরি দেওয়ার কথা। আন্দোলনের সময় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সভায় এটি দেবেন বলে মালিকরা জানিয়েছিলেন।’

জানতে চাইলে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, চা শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি নিয়ে তৈরি হওয়া সংকট আগামী ২৪-২৫ জানুয়ারির মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা যায়। তিনি জানান, সমস্যা সমাধানের জন্য গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক হয়েছে। তবে মজুরি বৃদ্ধির ফারাক বেশি হওয়ায় অনেক মালিকেরই তা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। ফলে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে টানাপড়েন চলছে। এ ছাড়া ১২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বেড়ে ১৭০ টাকা হওয়ায় বড় ফারাক তৈরি হয়েছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/01/17/1229737