১৭ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, ১:১৭

পাটকলসমূহের দুরাবস্থা প্রসঙ্গে

-ড. মো. নূরুল আমিন

সহযোগী একটি দৈনিক গত ১৪ জানুয়ারি দেশের পাটকলসমূহের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করে একটি করুণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে পাটকলগুলোর দৈন্যদশা, সরকারি অর্থের অপচয় এবং বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর কাজকর্মহীন কয়েক হাজার কর্মকর্তাকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন পরিশোধের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ অপচয় হচ্ছে তার একটি বিবরণী প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশে পাটশিল্পের ইতিহাস অত্যন্ত করুণ। বৃটিশ আমলে তৎকালীন পূর্ববাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে সারা দুনিয়ার ৮৫ শতাংশ পাট উৎপাদিত হতো। কিন্তু কাঁচামালের সহজ লভ্যতা, সস্তা উৎপাদিত শ্রমিকদের আধিক্য, স্থল ও নৌ যোগাযোগের প্রচুর সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যবশতঃ তখন এই অঞ্চলে কোনো পাটকল প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পশ্চিম বাংলার হুগলি নদীর তীরে ১০৮টি (মতান্তরে ১০১টি)। আবার বিদেশে কাঁচা পাট রফতানি ও চট্টগ্রামের স্বাভাবিক সমুদ্র বন্দর থেকে হতো না। এই পণ্য গাঁট বেঁধে কোলকাতায় নিয়ে কোলকাতা বন্দর থেকে বিদেশে রফতানি হতো। পূর্ব বাংলার নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরের নদীবন্দর সংলগ্ন কিছু এলাকায় এবং বুড়িগঙ্গা তীরে ও শীতলক্ষা পাড়ে কিছু জুট বের্লিং প্রেস স্থাপিত হয়েছিল। এই প্রেসগুলোতে প্রেসার দিয়ে গাঁট তৈরি করা হতো, একেকটির ওজন হতো আড়াই মণ। এগুলো শ্রমিকরা পিঠে কওে জাহাজে উঠাতো এবং সেগুলো কোলকাতা ও ডা-িতে যেত। পাটের শ্রেণীবিন্যাস ও কোয়ালিটি কন্ট্রোলের কোনো ব্যবস্থাও এখানে ছিল না।

শুধু পাট নয়, অনেক ব্যবসায়েই এই এলাকার মুসলমানদের জন্য প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, তাঁত ও তাঁতবস্ত্র তৈরি, মাছের ব্যবসা, লবণের ব্যবসা মুসলমানদের জন্য অপমানকর ছিল। যারা এসব ব্যবসা করতেন তাদের সাথে খান্দানী মুসলমানদের বৈবাহিক ও সামাজিক সম্পর্ক প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। ধোপার কাজ, চুল কাটার কাজ মুসলমানরা করতেন না। এগুলো একচেটিয়া হিন্দুদের কাজ ছিল। আবার মুসলমানদের জন্য ব্যবসায়ের পুঁজির পথও ছিল রুদ্ধ। সমবায় সমিতিসমূহ, কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক, জমি বন্ধকী সমবায় ব্যাংক, টাউন ব্যাংক সবগুলোই ছিল হিন্দুদের হাতে। তারা মুসলমানদের কর্জ দিত না, সুদী মহাজনরা অলংকার ও জমির বিনিময়ে তাদের টাকা ধার দিত, কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে সম্পত্তি দখল করে নিত। এই অবস্থায় মুসলিম পূর্ব বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বা শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে পারেনি।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে, সামগ্রিক অবস্থা বর্ণনা করতে গেলে আলোচনা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবার আশঙ্কায় এখানে আমি পাট শিল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই।

আগেই বলেছি, অনুকূল পরিবেশ না পাওয়ায় স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে এখানে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা গড়ে উঠেনি, শিল্প কারখানাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অন্যান্য মুসলমানদের সাথে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু অবাঙালি ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা এ অঞ্চলে হিজরত করেন, এদের মধ্যে আদমজি, ইস্পাহানি, করিম, লতিফ বাওয়ানীসহ কিশোর চান সারোগী, কল্যাণ চান সারোগী ও বহু মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী উল্লেখযোগ্য ছিলেন। এদের বেশিরভাগ সরকারি সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পাটকল স্থাপন করেন। আদমজি জুট মিল, করিম জুটমিল, বাওয়ানী জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, পাহাড়তলী জুট মিল, কওমী জুট মিল প্রভৃতিসহ সারা দেশে প্রায় ৭০টি জুট মিল গড়ে উঠে। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত জুট মিল ছাড়াও তখন সরকারি উদ্যোগে বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন বা ইপিআইডিসি কর্তৃক ও অনেকগুলো জুটমিল প্রতিষ্ঠা করে সেগুলো Managing Agency System-এর মাধ্যমে পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়, এদের ব্যবস্থাপনা দক্ষ ও অভিজ্ঞতা ছিল প্রশ্নাতীত এবং তাদের পরিচালনায় জুটি মিলগুলো প্রভূত সাফল্য অর্জনে সমর্থ হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জুট মিলের সংখ্যা ছিল ৭৮টি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর তৎকালীন সরকার এমন কয়টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যা পাটকলসমূহের বিকাশের জন্য অনুকূল প্রমাণিত হয়নি। এর প্রথমটি হচ্ছে, বিশে^র বৃহত্তম পাটকল আদমজি জুট মিলের জেনারেল ম্যানেজার আবদুল করিমকে বরখাস্তকরণ। তিনি সারা দুনিয়ার স্বীকৃতি একজন উচ্চমানের পাট বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাকে চাকরিচ্যুত করে তার স্থলে ছাত্রলীগের একজন সাবেক নেতা জনাব আবদুল আওয়ালকে নিয়োগ দেয়া হয়। তার দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা পাটকলটিকে ধ্বংস করে দেয়। দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি হচ্ছে পাটকলগুলোর পাইকারী জাতীয়করণ, সরকারের কাজ হচ্ছে সরকার পরিচালনা, ব্যবসা করা নয়। শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করে তৎকালীন সরকার সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর তার পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। এতে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি জেঁকে বসে এবং পাটকলগুলোর উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। বাজারজাতকরণ কৌশলের অভাবে লাখ লাখ টন পণ্য অবিক্রিত থেকে যায়। জুট গোডাউনগুলোতে আগুন লাগা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন তদন্ত রিপোর্টে বেরিয়ে আসে যে, এর প্রধান কারণ ছিল বীমা কোম্পানি থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়, তৃতীয় আরেকটি সিদ্ধান্ত জুট মিলগুলোকে ধ্বংস করেছে এবং তা হচ্ছে Idleness allowance বা অলস ভাতার প্রচলন। জুট মিলে অনেকগুলো ডিপার্টমেন্ট আছে। এর মধ্যে ব্যাচিং, প্রিপেয়ারি স্পিনিং টুইস্টিং রোল ওয়াইল্ডিং, কম্পওয়াইনডিং, বিমিং এবং উইভিং। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে জুট মিল শ্রমিক লীগের তৎকালীন সভাপতি আবদুল মান্নানের চাপে সরকার জুটমিলগুলোর তাঁত সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি করেন কিন্তু আনুপাতিক হারে অন্যান্য বিভাগের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করা হয়নি। ফলে বর্ধিত সংখ্যক তাঁতের জন্য কাঁচামাল সরবরাহে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো ব্যর্থ হয় এবং এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে হাজার হাজার তাঁত শ্রমিক বেকার বসে থাকেন। তাদের কোনো কাজ বা উৎপাদন ছিল না। তাদের সাথে যোগ হয় ফিনিসিং ডিপার্টমেন্টের শ্রমিকরাও। তারা উৎপাদনের ভিত্তিতে মজুরি পেতো। কিন্তু কাজ না থাকায় শ্রমিক লীগের চাপে টাইম রেট অনুযায়ী প্রতিদিন সাড়ে সাত টাকা হারে সরকার অলসভাতা (Idleness allowance) দিতে বাধ্য হন। এটা অনেকটা বর্তমান সময়ে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের মতো। উৎপাদন ক্ষমতার ভিত্তিতে বিনা উৎপাদনে ভাতা পরিশোধ। এতে জুট মিলগুলোর যে আর্থিক ক্ষতি হয় তা ছিল অপরিসীম। চতুর্থত, স্বাধীনতার পূর্বে প্রত্যেকটি পাটকলেই বিভিন্ন বিভাগের যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ তৈরি করার জন্য ওয়ার্কশপ ছিল। সরকার এই ওয়ার্কশপগুলো বন্ধ করে দেন এবং খোলা বাজার থেকে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে সংগ্রহমূল্য ও কেনাকাটায় দুর্নীতি বৃদ্ধি পায় এবং পাটকলগুলোর চলতি মূলধনে সংকট দেখা দেয়।

আবার আদমজির সাবেক জিএম আবদুল করিমকে বিপুল অংকের বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ভারত সরকার তাদের পাটশিল্প উন্নয়নের জন্য নিয়োগ দান করেন। তাকে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য হেলিকপ্টারও সরবরাহ করা হয়। আন্তর্জাতিক পাট সংস্থা (IJO) গঠন করা হয় এবং দিল্লিতে তার প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়। বাংলাদেশের পাট আস্তে আস্তে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে থাকে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পাটকলগুলোকে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়। শ্রমিকরা চাকরি হারায় এবং স্বর্ণসূত্র পাটও তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে।

পাটকলগুলো এখন পাটকল কর্পোরেশনের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজেএমসির হাতে এখন ৩৫টি পাটকল আছে। ২০২০ সালে ২৫টি পাটকল বন্ধ হবার পর এখন আর কোনো কারখানা চলছে না। পাটকলগুলোর অবস্থা নিম্নরূপ :

মোট পাটকল ৮২টি, ফেরত, পুঁজি প্রত্যাহার ও বিক্রি ৪৪টি, সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর ৩টি, বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণে ৩৫টি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া ৮টি, চালু ৪টি, এখনো বন্ধ ৩১টি।

বলাবাহুল্য কারখানাগুলো বন্ধ থাকলেও তাদের ২৫০০ কর্মকর্তাকে সরকার বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বিজেএমসির মোট জমির পরিমাণ ১৫১৭ একর। এই সম্পদ রক্ষা করাও তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের এখন প্রশাসনিক ও জমিজমা সংক্রান্ত ৮৯২টি মামলা আছে, এর মধ্যে ১৩৬টি জমিজমা সংক্রান্ত। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই প্রতিষ্ঠানটি ২৬০ কোটি ২৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। এর সাথে আরো যোগ হয়েছে বেতনভাতা বাবদ ১৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

এখানে উল্লেখ্য যে, ২০০৭-০৮ সাল থেকে ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত বিজেএমসি প্রতি বছর গড়ে ৬২৫ কোটি টপাকা নীট মুনাফা দিয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১২-১৪ সালে হেসিয়ান, স্যাকিং ও সিবিসি বাবদ ১০৯২ কোটি, ২০১৪-১৫ সালে ১১৫৩.০৪ কোটি, ২০১৫-১৬ সালে ১২৪৮.১৮ কোটি ২০১৬-১৭ সালে ১১৭৪.৮৭ কোটি, ২০১৭-১৮ সালে ১১৭৫.১৬ কোটি, ২০১৮-১৯ সালে ৭০০.১১ কোটি, ২০১৯-২০ সালে ৯১৫.৭৭ কোটি ২০২০-২১ সালে ৪৪২.১৬ কোটি টাকার মালামাল বিক্রি করেছে। এই বিক্রিত দ্রব্যের ব্যয় বাবদ তাদের খরচ হয়েছে যথাক্রমে ১৫২৭.৩৩ কোটি, ১৮০৬.৫৮ কোটি, ১৮২৮.৭০ কোটি ১৫৭৮.৯৯ কোটি, ১৫৯৫.৯৯ কোটি, ১২২৯.৩৯ কোটি ১৬২০.৩৩, ৭৭০.৬০ কোটি ও ২৫২.৩০ কোটি টাকা। সরকারি অর্থ ও সম্পদের এ ধরনের অপচয় অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নজিরবিহীন। সরকারি অর্থ জনগণেরই অর্থ। এর যথাযথ জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য বলে আমি মনে করি।

https://dailysangram.com/post/513898