১৬ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ৬:১৬

সমাজ ও সংস্কৃতির রূপান্তর

-ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

গোটা বিশ^সমাজ ও সংস্কৃতিতে রূপান্তর ঘটেছে, ঘটছে। এটি স্বাভাবিক। বাংলাদেশেও এ রূপান্তরপ্রক্রিয়া চলমান। তবে দেখার বিষয়, অনুধাবনের ব্যাপার, বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে রূপান্তরের গতিধারা কোন মাত্রায় গতিশীল, কতটা প্রতিক্রিয়াশীল এবং তার আলোকে এ সমাজ ও সংস্কৃতি এগোচ্ছে না পেছাচ্ছে। এর সারবত্তা কোথায় গিয়ে স্থিতিশীল বা টেকসই হচ্ছে। হিসাববিজ্ঞানীরা যেমন ব্যালান্স শিট কষেন, তুলে ধরেন কোম্পানির মুনাফা ও ক্ষয়ক্ষতি অবচয়ের অঙ্ক, দেশ ও জাতির সমাজ ও সংস্কৃতিরস্বরূপ সে নিরিখে নির্ণয় না চললেও এটি অবলোকনের অবকাশ থেকে যায় যে, উদ্ভূত কিংবা অনাগত পরিবেশ-পরিস্থিতিতে কতটা সংবেদনশীল, কতটা আত্মস্থ করার প্রেরণা ও প্রত্যয় সমকালীন সমাজ এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ থেকে প্রাপ্তি ঘটবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নির্মাণ পরিকল্পনাকালে এ অভিজ্ঞান পুষ্টিকর হিসেবে পাওয়া চাই। ইতিহাস থেকে কতটা শিক্ষাগ্রহণ করা হবে সেটিও। অন্যেরা অধম ছিল বলে নিজেরা উত্তম হবো কি না এ বিচার-বিবেচনাবোধ সজাগ ও সক্রিয় না থাকলে অধমের অসার অনুকরণে অনুসরণ হবে সার। সমাজ ও সংস্কৃতির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় নিজেদের অবদানকে অর্থবহ করতে হলে দেশ জাতি সমাজ ও অর্থনীতিকে অবশ্যই নিজেদের শক্তিমত্তা (স্ট্রেংথ) ও দুর্বলতা (উইকনেস), সুযোগ (অপরচুনিটি) ও ঝুঁকির (থ্রেট) বিষয়গুলোয়, জায়গাতে সচেতন দৃষ্টি অব্যাহত থাকা চাই।

চরণপুরের মতিন মোল্লার পাঁচ মেয়ে আর আট ছেলের ঘরে নাতিপুতি মিলে প্রায় শ’ খানেক হবে। সেই সব নাতিপুতির আবার পোলাপান হয়েছে তার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে মোটামুটি শ’ তিনেক। আপন চাচাতো মামাতো ফুপাতো খালাতো ভাইবোন বা এক কথায় যারা ইংরেজিতে ফার্স্ট কাজিন নামে পরিচিত। বাঙালির হাতে অনেক সময় তাই তাদের শব্দমালায় চাচাতো মামাতো ফুপাতো খালাতো কতসহ শব্দ আছে- ইংরেজের হাতে সময় কম তারা- ‘ফার্স্ট কাজিন’ বলে খালাস, এর ভেতর ওরা সবাই। ইংরেজরা যেমন- ইউ শব্দের মধ্যে তুই তুমি তোমরা সবাইকে ভরিয়েছে।

মতিন মোল্লা অবস্থাপন্ন মানুষ। এবারের শীতে সখ হলো নাতিপুতিসহ সবাইকে নিয়ে তার বিরাট মঞ্জিলে মাহফিল বা সম্মেলন বা মেজবান করবেন। গত দু’বছর করোনার কারণে তার বৃহত্তর পরিবারের মধ্যে কারো তেমন যাতায়াত ছিল না বললে চলে। মেয়েদের নায়রি আনবেন তারা ও তাদের ছেলেমেয়েদের তস্য-তস্যদের নিয়ে আসবে। মতিন মিয়া তার বড় ছেলের বড় মেয়ের বড় ছেলে মহিবুলকে দায়িত্ব দিলেন তালিকা তৈরিতে দুই জেনারেশন পর্যন্ত কত সদস্য হয়। মহিবুল চৌকস ছেলে-পরিসংখ্যানে পড়াশোনা করছে, সে এসব করতে করতে তার দাদুকে বারবার এটা সেটা প্রশ্ন করছে। মতিন মিয়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রিকুলেট। আজকালকার নাতিপুতিদের ফেসবুক ওয়াটসঅ্যাপ এসব অতশত বোঝেন না। ভাইরাস ভাইরাল ভয়ানক শব্দ। গুগল নামে কি এক সবজান্তা আছে কম্পিউটারে তার কাছে যা কিছুই জানতে চাওয়া হোক না কেন- নিমিষের মধ্যে এনার তথ্যভাণ্ডার নিয়ে হাজির। মহিবুলের প্রথম সমস্যা ফার্স্ট কাজিনদের শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে। তার চাচা ফুপুরা সিনিয়র ফার্স্ট কাজিন গ্রুপ (এসএফসিজি) আর তার নিজের মামাতো ফুপাতোরা টু-জি (সেকেন্ড জেনারেশন) ওরফে জুনিয়র ফার্স্ট কাজিন গ্রুপ (জেএফসিজি)। সে মতিন মিয়ার সাথে আলাপ করে সিনিয়রদের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ ও জুনিয়রদের নি¤œকক্ষ এমন ধরনের দু’টি শ্রেণীতে ভাগ করে ফেলল। সিনিয়রদের বয়স বেশি, অনেকের স্বাস্থ্যগত সমস্যা- ডায়াবেটিস আছে, কারো কারো চোখে ছানি অপারেশন হয়েছে। অনেকে চাকরি থেকে অবসরও নিয়েছেন। খাওয়া দাওয়ার রেস্ট্রিকশন- এসব দেখতে হবে, এরা রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, মান্না দে, আঙুর বালা, হেমন্তের গান বড়জোর সাবিনা পর্যন্ত এদের চলে। কিন্তু জুনিয়রদের কাছে ব্যান্ড সঙ্গীত ছাড়া চলবে না। খেতে দিতে হবে টাইগার জাতীয় এনার্জি ড্রিংকস, ওয়াইফাই ফেসবুক দেখার সুবিধা, চাই এন্তার দাবি সবার। দু’জেনারেশনের ফার্স্ট কাজিনদের এক জায়গা করার বিস্তর ঝামেলা। মহিবুল প্রমাদ গোনে। কিন্তু মতিন মিয়া যত সমস্যা দেখেন তাতে তত আনন্দ পান, উৎফুল্লø বোধ করেন। তিনি দেখতে চান সমাজ কিভাবে বদলাচ্ছে। কিভাবে পরিবর্তন হচ্ছে রুচিতে। চিন্তা চেতনার স্তরে কী কী পরিবর্তন। বোঝাপড়ায় কী এবং কেন বিস্তর ফাঁক। কেন মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে যাচ্ছে। কেন বিয়ে টিকছে না। উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতিকে তিনি এক নম্বর আসামি হিসেবে আর্জিতে রাখতে চান। শিক্ষাব্যবস্থায় ধান্দাবাজ নীতি নির্ধারককে তিনি রাজসাক্ষী করার পক্ষপাতী।

৩ মাঘ মঙ্গলবার মতিন মঞ্জিলের মিলনমেলা। পৌষমেলার মতো- পিঠা উৎসবের মতো মতিন মঞ্জিলে মিলবে সবাই। থিম সং ঠিক করা হয়েছে ‘পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন ফিরে আর আসবে কি কখনো’-মান্না দের গানটি মতিন মোল্লøার বড় ছেলের বড় মেয়ে ময়নার খুব পছন্দ। মহিবুল এ মুহূর্তে যদিও জুনিয়র ফার্স্ট কাজিন গ্রুপের (জেএফসিজে) আহ্বায়ক, তার পছন্দ একটু আধুনিক- একটু পপ, একটু বিটলেস, একটু দলছুট, একটু ডিফারেন্ট টাস জাতীয় কোনো গান। যাই হোক, মতিন মোল্লøা মনে করেন মান্না দে, এখনো তার গানই ভালো। মান্না দে ঘরানার শিল্পীরা তো প্রায় সবাই ওপারে এখন। গেলবার লতা, সন্ধ্যা, বাপ্পি লাহিড়ি সবাই চলে গেলেন। যাক, থিম সং নিয়ে এত মাতামাতি মতান্তর করে লাভ নেই- মহিবুল রণে ভঙ্গ দেয়। সবাইকে ইনভাইট আই মিন দাওয়াত পাঠানো হয়েছে- আপামর বাংলাদেশের ভূসীমায় যারা আছে তারাই আসবে। মার্কিন মুলুকের কানেকটিকাট থেকে ডা: জাহির আর তার দু’মেয়ে দু’গ্রুপে তারা- কিন্তু আসার সুযোগ তো আর এ ধরনের হঠাৎ আমন্ত্রণ রক্ষায় মেলে না, তারা দূর থেকে শুভেচ্ছা জানাল। মেলবোর্ন থেকে মল্লিøকা আর তার তিন ছেলে তমাল কামাল ও জামাল মন খারাপ করে ইমেইল পাঠিয়েছে। ওয়াটসঅ্যাপ ফেস টাইমে কথা বলেছে তারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির মতো তারা বলেছে- নিয়মে ও নিয়ন্ত্রণে সব কিছু করাকে তারা ভালোভাবে নিতে পারছে না। মতিন মোল্লøা বলেছেন, সবার কথা এক সাথে শোনা সম্ভব না। জাপানের টোকিও থেকে নাবিলা আর তাদের মা জুলিয়েট জানিয়েছে, পারিবারিক সম্মেলন হচ্ছে ভালো কথা কিন্তু যারা যোগ দিতে পারছে না তাদের জন্য যেন কিছু একটা গিফট পাঠানো হয়। এ ধরনের হরেক রকম দাবি-দাওয়া লন্ডন, টরন্টো, সৌদি আরব আর কাতার ও কুয়েত থেকে। মতিন মোল্লøা ভাবেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে তার রক্তের সম্পর্কের সবাই। বাঙালি ঘরে বসে নেই। এই বাংলাদেশের ভেতরেও জেলা-উপজেলা বাছ-বিচার নেই। সবখানে- ছাগলনাইয়া, ডোমার কিংবা গাংনী, জকিগঞ্জ, শ্যামনগর- সবখানে মোল্লøার কেউ না কেউ আছে। এক সময় চট্টগ্রামের লোকেরা চাঁটগায়ের বাইরের তাবৎ জগৎকে নোয়াখালী বলে ব্যঙ্গ করত এবং পারতপক্ষে তাদের সাথে আত্মীয়তা পাতাতে চাইত না। আর এখন খাইছনির সাথে ‘গম আছ’র সম্পর্ক হচ্ছে। একটি বিষয় ভালো- এ সম্মেলন সমাবেশে কোনো বাহিনীর অনুমতি নেয়া লাগবে না। ব্রিটিশরা পুলিশ আইনে এ ধারা রেখে গিয়েছিল যে, কোনো এলাকায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে এমন আশঙ্কায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করতে তার ব্যয়ভার ওই এলাকার মানুষদের বহন করতে হতো। এখন ব্রিটিশের পরিবর্তে নিজেরাই নিজেদের প্রশাসক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নাম করে (সরকার) বিরোধীপক্ষের অজ্ঞাত সংখ্যক আসামির মধ্যে গ্রেফতারের ভয় ঢুকিয়ে কমিশন কামাইয়ের সুযোগ যেন তৈরি হয়েই আছে। মতিন মোল্লা মনে করেন, বরং ব্রিটিশ আমল কিছুটা হলেও ভালো ছিল, ঔপনিবেশিক আমলে অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকার প্রতিবিধান দেরিতে হলেও মিলত, এখন স্বাধীন দেশে মাঝে মধ্যে, ক্ষেত্রবিশেষে আম-ছালা দুটোই যাচ্ছে, যাওয়ার আয়োজন এন্তেজামের কমতি নেই। এখন জনগণের সেবার মান উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টা চলে গাণিতিক হারে, অপরদিকে পক্ষপাতমূলক অত্যাচার, অন্যায়-অনিয়ম বাড়ছে যেন জ্যামিতিক হারে।

৭ পৌষের দু’দিন আগ থেকে সবাই আসা শুরু করেছে।। লঞ্চে ইস্টিমারে সড়কে সবাই আসছে। পদ্মায় সেতু হওয়ায় সড়কপথে সত্বর আসা-যাওয়া করা যায়। নানান দুর্ঘটনায় তো পড়াটা পানশে হয়ে গেছে। এবার কুয়াশা ও শীত বড্ড বেশি মনে হচ্ছে। লঞ্চ রাতে চলতে পারে না- ইস্টিমার চরে আটকে যায়, প্লেøন ল্যান্ড করতে না পেরে উড়াল দিয়ে যায়, রাস্তায় ফগলাইট জ্বালিয়েও চলতে পারে না ময়নার ড্রাইভার। সে আসছে ঢাকা থেকে। মতিন মঞ্জিলে সাজ সাজ রব। প্রথম ফার্স্ট কাজিন সম্মেলন-২০২৩ উদ্বোধনের আর একদিন বাকি। খালা ফুপুদের শোরগোলে এলাহি কারবার। রংপুর থেকে আসছেন ছবি খালার পরিবার। তার মেয়েরা বিদেশে; খালা-খালু একা আসছেন। রংপুরে শীত একটু বেশি- ওনাদের বয়সও বেশি। অনেক দিন তাদের মতিন মঞ্জিলে আসা হয় না। এটি একটি ভালো উপলক্ষ।

মতিন মঞ্জিলে যাদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছিল তারা বেশির ভাগ এসএফসিজির সদস্য। দেখা গেল তাদের আড্ডাটা যেন জমছে বেশি। কেননা, এরা সবাই সমবয়সে একটি শান্ত সমাহিত সুমধুর পরিবেশে এখানে বড় হয়েছিলেন। তখন সমাজ সংসারে এত টানাপড়েন শুরু হয়নি। ভাইবোনরা গলাগলি করে চলত। খুনসুটি যে ছিল না তা নয়- তখন সুখ-দুঃখ, আনন্দ-সর্বনাশের সংবাদ সবাই শেয়ার করত। সমবেদনা জানাত। সহমর্মিতা বোধটা বেশ জাগ্রত ও দৃশ্যমান ছিল। এখন প্রত্যেকে কেমন যেন একা একা। নিজেদের সব কিছু পাসওয়ার্ড দিয়ে আড়াল করতে চাইছে। নেটওয়ার্কেও সব কিছু শেয়ার করতে চায় না। পাছে ভাইরাস এসে তার ফাইল ক্রাশ করে এ ভয়ে। আগে এ ভয় যে ছিল না; তা নয়। কিন্তু তখন জানাজানির জগৎ এত ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল না বলে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা বোধটা গাঢ় ছিল- আর এখন তথ্য আদান-প্রদানের বলয় বিশ্বব্যাপী এবং স্বল্পতম সময়ে সব কিছু হাতের নাগালে পাওয়ার ব্যবস্থা থাকায় মনোনিবেশে তাড়া নেই। গাঢ়তা নেই বন্ধুত্বে, ছাড়াছাড়িতেও লাগে না সময়। যা গড়ে ওঠে সহজে তা ভাঙেও সহজে। গড়ে ওঠার সময় তো কম এখন গাঢ় হওয়ার সুযোগও কম, সুতরাং ভাঙাভাঙিও ফাটাফাটি।

শহর চষে জোগাড় হলো ৭০ ইলিশের চালান। যাই হোক, ফার্স্ট কাজিন কনফারেন্স উদ্বোধন আগামীকাল। রহমত মোল্লা আর তার স্ত্রী রোমেনা বেগম কাল সকালে পিঠাপুলি সহযোগে উদ্বোধন বা সূচনা ঘটাবেন এ সম্মেলনে, রোমেনা বেগমের শরীরটা ভালো না। ডায়াবেটিস আদৌ কন্ট্রোলে নেই- এ বয়সে হাঁটাচলা তেমন নেই আর খাওয়া দাওয়ায় এত বাছ-বিচার করে চলাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। ৮০ বছরের বেশি বয়স তার। স্বামীর ঘরে এসেছিলেন সেই ১২ বছর বয়সে, সে হিসাবে ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি ঘর করছেন। সামলিয়েছেন সংসার। মহিবুল একটা ‘সারপ্রাইজ’ তার কাছে গোপনে পুষছে। আজকাল বিভিন্ন কনফারেন্সে বিশেষ ব্যক্তিদের বিশেষ সম্মাননা দেয়ার রেওয়াজ আছে। এ জাতীয় কিছু আছে। ‘এর বেশি এখন কিছু বলা সমীচীন হবে না’ সম্মেলনের আগের রাতে ‘মিট দ্য প্রেস’ জাতীয় মহড়ায় বলল মহিতুল। মতিন মঞ্জিলের নিচ তলার বৈঠক ঘরে সন্ধ্যা ৭টায় মিনি সংবাদ সম্মেলন করে মহিতুল ফার্স্ট কাজিন কনফারেন্সের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। দৈনিক হয়রানি পত্রিকার প্রতিনিধির এক প্রশ্নের জবাবে মহিতুল জানায়, এ সম্মেলন হবে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও এখানে পরিবেশিত সব খাবারই ফরমালিনমুক্ত। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকে সরকারি চাকুরে, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী থাকবেন ও বেকার ব্যক্তিত্ব থাকবেন বিধায় এখানে খোলামেলা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ জাতীয় কনফারেন্স এবারই প্রথম, আয়োজকরা আশা করছেন অনেক ইতিবাচক চিন্তাভাবনা বেরিয়ে আসবে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া চ্যানেল ৪২০-এর রিপোর্টার রঞ্জন জানতে চান, কনফারেন্সে কোনো ঘোষণা বা চুক্তি এমওইউ জাতীয় কিছু স্বাক্ষরের সম্ভাবনা আছে কি না। মতিন মোল্লা সংবাদ সম্মেলনে শেষের দিকে এসে যোগ দেন। তিনি জানান, ‘মামা-ভাগ্নে যেখানে’ জাতীয় একটি ঘোষণাপত্র তৈরির পরিকল্পনা আছে- নেপোটিজম ফেরারিটিজম হওয়ার যে ক্রনিক রোগ সবখানে দেখা যায় কনফারেন্সে তার ওপর একটি ধারণাপত্র পেশ হতে পারে, সেখানেও এ ব্যাপারে কিছু বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ মতামত বেরিয়ে আসবে বলে তিনি মনে করেন। মোল্লা আরো মনে করেন, পুরনো গানের দিকে পুরনো ছবি দেখার পক্ষে সিএফসিজিদের তরফ থেকে দাবি উঠতে পারে এবং সঙ্গত কারণে জেএফসিজিদের পক্ষ থেকে তার বিপরীত বক্তব্য আসবে। তিনি এ দু’টোর মধ্যে সমন্বয়ের সূত্র আবিষ্কারের আভাস দেন। পুরনো গান নতুনদের মুখে রিমেক করার কথার দিকে তিনি ইঙ্গিত দেন। সংবাদ সম্মেলনের এ সময়টাতে পাশের রুমে ‘আরো কিছুটা সময় না হয় রহিলে কাছে’ জাতীয় গান ব্যান্ডে তোলার সুর ভেসে আসছিল।

কনফারেন্সে খাবার দাবারে বৈচিত্র্য প্রত্যাশা করছেন অনেকে। নতুনরা জাঙ্ক ফুড খেতে চাইছে কোকা কোলা ড্রিঙ্কস- এসব জম্পেস জমবে। পুরনোরা বেশির ভাগই নানান রোগ বাতিকগ্রস্ত। তারা ডায়েট ড্রিঙ্ক, ভেজিটেবলস খেতে ও রেড মিট জাতীয় খাবার না খাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। খাবার দাবার আয়োজনকারী কমিটির প্রধান সরকারের সমাজকল্যাণ দফতরের পরিচালক এবং সিএফসিজির সদস্য রোমিও হক সংবাদ বন্ধুদের জানালেন- আমরা ডেলিগেটদের কাছ থেকে যে সব ফরমায়েশ পেয়েছি তাতে নানা বৈচিত্র্য লক্ষ করেছি। কেউ চেয়েছে চ্যাপা শুঁটকি, আবার হ্যাম বার্গার পেতে চেয়েছেন অনেকে। এত আকাশ-পাতাল কিভাবে সমন্বয় হবে বুঝছি না। খেজুরের রস পেতে চেয়েছেন ২৬ শতাংশ ডেলিগেট। চিকিৎসক বন্ধুরা জানিয়েছেন- নিপাহ ভাইরাসের ভয় আছে তাতে। আমরা দু’টো উপায় বিবেচনায় রেখেছি এ ব্যাপারে- ১. এই শহরের সব বাদুড়কে দু’দিনের জন্য ‘গৃহবন্দী’ (যেমন- শহরে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের পরিবেষ্টন করে রাখা হয়) রাখা অথবা ২. প্রতিটি রসের পাত্রের কাছে একজন করে দারোয়ান দাঁড় করিয়ে রাখা বাদুড় তাড়ানোর জন্য (এটিএম বুথ যেমন একজন পাহারাদার সবসময় বসিয়ে রাখা হয়)। দৈনিক টাকা পয়সা প্রতিদিনের প্রতিনিধি মুখের ওপরই মন্তব্য করলেন- এতে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে যাবে না? রোমিও হক বললেন, সদস্যদের সুস্থতা আমাদের আছে অন্য অনেক কিছুর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কনফারেন্সে কোনো নাশকতামূলক কিছু ঘটা বা ঘটানোর আশঙ্কা তারা করছেন কি না এমন প্রশ্ন রাখলেন সাপ্তাহিক সুনীতি সম্ভারের প্রতিনিধি। মতিন মোল্লা বললেন, এটি আপন রক্তসম্পর্কীয় স্বজনদের সম্মেলন, ক্ষমতাসীন বড় দলের কনফারেন্সের মতো, এখানে রাগারাগি মান-অভিমান পর্যন্ত ব্যারোমিটার উঠতে পারে তার পর কিছু নয়। আর তা ছাড়া এক কারণের জন্য অন্য সব কারণকে টেনে আনার কোনো পরিকল্পনা এখানে থাকবে না- এখানে কোনো হাইব্রিড নেতৃত্ব, সংস্কারবাদী কিংবা ফরমালিনযুক্ত মনোভাবের কারো সক্রিয় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা দেখছি না, সেহেতু আমার মনে হয় না এখানে নাশকতার কোনো সম্ভাবনা থাকবে। তবে সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস কিংবা সদ্য সমাপ্ত উপনির্বাচন, রসিক ভোটে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে চলমান বিতর্কের একটি পরোক্ষ প্রভাব কনফারেন্সে আলাপ-আলোচনা পরামর্শ পর্বে ফস করে ঢুকে পড়লে আমাদের করার কিছু থাকবে না। তবে আইনশৃঙ্খলা কমিটির প্রধান তিনি নতুন এসেছেন কিছুক্ষণ আগে- তার বাচনভঙ্গি ও শব্দ চয়নের নয়নে নাচনে আশা করা যার যা মেসেজ পাওয়ার তা তারা পাবে। আজকাল কাজের চাইতে বাক্যবাগিশের জয়জয়কার; তবে কারো কারো শব্দ অপব্যবহারের খেসারত যে দিতে হয় না তা নয়। সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, এ কনফারেন্স ঘিরে মতিন মোল্লার নাতিপুতিদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব সাড়া পড়েছে এ ৮৫ বছর বয়সে তিনি তাতে বিশেষ উৎফুল্ল বোধ করছেন। যদিও কনফারেন্সের সাফল্য কামনা করে ছোট-বড় ছবি দিয়ে এখনো কোনো পোস্টার চোখে পড়েনি। বৃদ্ধ মোল্লøা চোখ নামিয়ে প্রসঙ্গটি তুললেন আজকাল পোস্টার ফেস্টুনের নতুন চল চালু হয়েছে। সেখানে উপরে আগে একজন এখন দু’জন তিন জনের ছবি ছোট হচ্ছে আর বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়র মতো নিচে থাকে আসলের চেয়ে নকল নেতাদের ছবি। ভাবখানা এই- এলাকাবাসী আমাকে চিনুক।
লেখক : সমকালীন আর্থসামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতির বিশ্লেষক

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/720633