১৬ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ৬:১২

প্রসঙ্গ সিকিমের লেন্দুপ দর্জি

-আশিকুল হামিদ

ব্রিটিশ শাসনমুক্ত স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর একটি স্বপ্ন বা পরিকল্পনা প্রসঙ্গে বিশেষ করে বাংলাদেশে মাঝেমধ্যেই আলোচনা হতে দেখা যায়। এর পছনে যেমন বিশেষ কারণ থাকে তেমনি এ্ই আলোচনার মাধ্যমে দেশপ্রেমিককদের মধ্যে উদ্বেগ-আশংকাও প্রবলভাবেই ছড়িয়ে পড়েছ। কেনÑ সে প্রশ্নের উত্তর এই নিবন্ধ পড়লে পাঠকরা নিজেরাই পেয়ে যাবেন। সেদিকে যাওয়ার আগে পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু সম্পর্কে সংক্ষেপে জানানো দরকার। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ব্রিটিশরা বিদায় নেয়ার পর এই নেহরু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। নামে গণতন্ত্রের পূজারী হলেও পদটিতে ছিলেন তিনি ১৯৬৪ সালে মৃত্যুর সময় পর্যন্ত। ওই সময়কালে পাঁচ বছর পর পর জাতীয় তথা লোকসভা ও রাজ্যসভার নির্বাচন নিয়মিতভাবেই হয়েছে, কিন্তু মিস্টার নেহরুকে কেউ সরাতে পারেননি।

দুর্দান্ত ক্ষমতাধর নেহরুর ক্ষমতালিপ্সাও যথেষ্টই ছিল। বাংলাদেশের স্টাইলে পারিবারিক রাজত্বের ভিত্তিও তিনিই স্থাপন করে গেছেন। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসে শত শত যোগ্য, ত্যাগী, সংগ্রামী ও অভিজ্ঞ নেতা থাকা সত্ত্বেও নিজের মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি দলের প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিলেন। সে অবস্থানের সূত্র ধরেই ইন্দিরা গান্ধী পরবর্তীকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ইন্দিরার পর প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তার ছেলে রাজিব গান্ধী। গত বছর, ২০২২ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের প্রধান নেত্রী ছিলেন সোনিয়া গান্ধীÑ ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধু। এখন প্রস্তুতি চলছে ইন্দিরার নাতি ও সোনিয়া-রাজিবের ছেলে রাহুল গান্ধীকে দলের নেতৃত্বে আনার এবং সম্ভব হলে প্রধানমন্ত্রী বানানোর। ২০২১ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটায় রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হতে না পারলেও ভারত এখনো নেহরু ডাইনেস্টির রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। ইতিহাসের এই প্রেক্ষাপটে তাই বলা যায়, জওয়াহেরলাল নেহরু সাধারণ কোনো নেতা ছিলেন না। ‘মহাত্মা’ নামে পরিচিত মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধীর আবির্ভাব না ঘটলে ভারতীয়দের জাতির পিতার আসনটিও নেহরুর দখলেই চলে যেতো। সে ‘যোগ্যতা’ তার ছিল।

এবার পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুকে টেনে আনার কারণ সম্পর্কে বলা যাক। ব্রিটিশরা বিদায় নিলেও মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান যাতে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে সে ব্যাপারে গান্ধী ও নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস এবং ভারতীয় হিন্দুরা শেষ পর্যন্তও চেষ্টা করেছিল। দাঙ্গার অড়ালে তাদের হাতে হাজার হাজার অসহায় মুসলমান নারী-পুরুষ ও শিশুর মৃত্যু ঘটেছে।

এত কিছুর পরও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় দলের ভেতরে-বাইরে তীব্র নিন্দা-সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন গান্ধী ও নেহরু। মিস্টার গান্ধীকে তো মেরেই ফেলা হয়েছিল। অমন এক অবস্থার মধ্যেই নেহরু তার ঐতিহাসিক ‘ভিসন’ বা স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘ভারত মাতার’ এই বিভক্তি নিতান্তই সাময়িক ব্যাপার। ভারতকে আবারও পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। অর্থাৎ এক রাষ্ট্রে পরিণত করা হবেÑ ‘ভারত মাতা’ অখন্ডই থাকবে। নেহরুর এ ‘ভিসন’কে দলীয় প্রস্তাব আকারে গ্রহণ করেছিল কংগ্রেস। এটা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরের মাস ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নেতৃত্বে ‘ভারত মাতাকে’ অখন্ড তথা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কর্মকান্ডও শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ছয় মাসের জন্য কোলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল বলেছিলেন, ছয় মাসের প্রশ্ন ওঠে না, ছয় ঘন্টার জন্যও ঢাকাকে কোলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। আগ্রহী পাঠকরা এসব বিষয়ে জানার জন্য আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ দুটি পড়ে দেখতে পারেন। দেখবেন, পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের ব্যাপারে নেহরুসহ ভারতের হিন্দু নেতারা কতটা ভয়ংকর ও হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করতেন।

এভাবেই শুরু হয়েছিল। সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে এখনো। পাকিস্তানের ভাঙন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটার পর ভারতীয়দের তৎপরতা সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। উদাহরণ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয়দের সম্প্রসারণবাদী নীতি-কৌশল ও অসংখ্য কর্মকান্ডের উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০১৭ সালে ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদীর ঢাকা সফরের উল্লেখ ও পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মিস্টার মোদীর ওই সফরকালে স্বাক্ষরিত ডজন ডজন চুক্তি ও সমঝোতাপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ আদৌ কিছু পায়নি বরং নেহরুর সেই ‘ভিসন’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভারতের পক্ষে মিস্টার মোদিই সবকিছু নিয়ে গিয়েছিলেন। ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন দেশপ্রেমিকরা প্রসঙ্গক্রমে ‘সিকিম সিনড্রম’-এর কথা তুলেছিলেন। সেই সাথে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল লেন্দুপ দর্জির নামও। এই লেন্দুপ দর্জি ছিলেন হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত স্বাধীন রাষ্ট্র সিকিমের শেষ প্রধানমন্ত্রী। সিকিমের ‘মির জাফর’ হিসেবে নিন্দিত রাজনীতিক লেন্দুপ দর্জির পরিণতির কথঠর সে সময় স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছিল।

‘সিকিম সিনড্রম’ নিয়ে কেন আলোচনা প্রাধান্যে এসেছিল তার কারণ জানার জন্য ইতিহাস স্মরণ করা দরকার। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সিকিমও স্বাধীন রাষ্ট্রের অবস্থান অর্জন করেছিল। গায়ের জোরে হায়দরাবাদসহ ক্ষুদ্র কয়েকটি রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করলেও কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু সিকিমের স্বাধীনতা হরণ করা থেকে বিরত ছিলেন। অবস্থায় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল ১৯৬৮ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসস উইং) গঠিত হওয়ার পর। ‘র’ সিকিম ও ভুটানকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৮ সালেই জাতিসংঘের সদস্যপদ পেয়ে যাওয়ায় ভুটান ‘র’-এর হাতছাড়া হয়ে যায়। ‘র’ তখন সিকিমের দিকে হাত বাড়ায় এবং দালাল হিসেবে বেছে নেয় রাজনীতিক লেন্দুপ দর্জিকে। লেন্দুপ ছিলেন সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস (সিএনসি)-এর নেতা। ‘র’-এর প্ররোচনায় সিএনসি রাজা চোগিয়ালের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে।

সিকিমবাসীকে বোঝানো হয়, রাজতন্ত্রের অবসান ঘটানো গেলেই তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, সিএনসির সে আন্দোলনে ‘র’ প্রায় প্রকাশ্যেই অংশ নিয়েছিল। হাজার হাজার ভারতীয় সেনাকে সে সময় মিছিলে ও সমাবেশে অংশ নিতে দেখা গেছে। কিন্তু সিকিমবাসীর মতো একই পার্বত্য চেহারার ছিল বলে তাদের পৃথকভাবে শনাক্ত করা যায়নি।

রাজতন্ত্র বিরোধী ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সিএনসি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে দেশটির সংসদে ৩২ আসনের মধ্যে ৩১টিতে বিজয়ী হয়। প্রধানমন্ত্রী হন লেন্দুপ দর্জি। নিরংকুশ এ বিজয়কেই লেন্দুপ দর্জি ভারতের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। সংসদের মাধ্যমে প্রথমে তিনি রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে নিয়েছিলেন সিকিমকে ভারতের রাজ্য বানানোর পদক্ষেপ। এ উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালের ১৪ এপ্রিল একটি লোক দেখানো গণভোটের আয়োজন করা হলেও ‘র’-এর সর্বাত্মক হস্তক্ষেপ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতির কারণে সাধারণ সিকিমবাসী ভোট দেয়ারই সুযোগ পায়নি। ফলে তথাকথিত গণভোটে ভারতে যোগ দেয়ার প্রস্তাব পাস হয়েছিল। ক’দিন পর, ১৯৭৫ সালেরই ২৬ এপ্রিল সিকিমের সংসদ সিকিমকে ভারতের রাজ্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ভারত সরকারের কাছে অনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছিল। সে অনুরোধের ভিত্তিতে সিকিমকে ভারতের ২২তম রাজ্য বানানো হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুগ্রহে সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন লেন্দুপ দর্জি। এভাবেই জাতীয় পর্যায়ের একজন জনপ্রিয় নেতার বিশ্বাসঘাতকতায় স্বাধীনতা খুইয়েছিল সিকিম।

লেন্দুপ দর্জি নিজেও অবশ্য মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হয়েছিলেন। চার বছরের মধ্যে ১৯৭৯ সালেই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদ হারিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে সিকিমবাসী তাকে ঘৃণার সঙ্গে বিতাড়িত করেছিল। জনগণ তাকে এতটাই ঘৃণা করেছে যে, মৃত্যুর সময়ও লেন্দুপ দর্জি সিকিমে আসতে পারেননি। ভারতের কলিমপঙে ২০০৭ সালে তাকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। মৃত্যুর আগে দেয়া একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলে গেছেন, দিল্লি অর্থাৎ ভারত সরকার তাকে আর আগের মতো সম্মান দেখায় না। দ্বিতীয় সারির কোনো ভারতীয় নেতার সঙ্গে কথা বলার জন্যও তাকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়।

https://dailysangram.com/post/513787