১৫ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ১১:০৩

পরিকল্পনা থেকে সমন্বয় সব ক্ষেত্রে গলদ

রাজধানীর ফুলবাড়িয়ায় সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল পুনর্নিমাণ কাজের অগ্রগতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। দীর্ঘ তিন বছর প্রকল্পের অডিট না হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। দুই বছরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তিন বছরের বেশি সময়ে আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১৯ শতাংশ। ভৌত অগ্রগতি ২৩ শতাংশ। বর্তমানে নির্মাণাধীন হাসপাতালটির চারতলা ভবন পর্যন্ত চিকিৎসা চলছে।
আইএমইডি জানিয়েছে, প্রকল্পের নকশা পরিবর্তনের কারণে স্থাপনা পুনর্নির্মাণে ছাদ ও দেয়ালের ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া হাসপাতালের বর্জ্য অপসারণেও সমস্যা হতে পারে।

ফুলবাড়িয়ায় বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতালটি সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে রূপান্তরের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছিল। ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এটির দায়িত্ব বুঝে নেয়। যদিও রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, হাসপাতাল নির্মাণ ও পরিচালনা জনপ্রশাসনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। একই বছরের ২৮ আগস্ট ওই স্থানে ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে এটিকে ৫০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়।

২০১৯ সালের মার্চে স্থাপত্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৩৭৯ কোটি ৯৬ লাখ ৫১ হাজার টাকার প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। একই মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৬ তলাবিশিষ্ট ৫০০ শয্যার এই হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে এর নির্মাণকাজ বারবার ব্যাহত হয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যেসব কারণে হাসপাতালের নির্মাণকাজ ব্যাহত হয় এর মধ্যে রয়েছে একাধিকবার পরিচালক বদল, নকশা বদল করে নির্মাণকাজে পরিবর্তন, সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনে বিলম্ব হওয়া, কর্মকর্তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ, দীর্ঘ সময় প্রকল্প ব্যয়ের নিরীক্ষা না হওয়া, পুরনো লাল ভবন না ভেঙেই প্রকল্পের কাজ শুরু করা, রক্ষণাবেক্ষণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা না থাকা এবং পরবর্তী সময়ে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়া।

প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হলেও কাজে সেভাবে অগ্রগতি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক চিঠিতে জানা যায়, গত তিন বছরের বেশি সময়ে প্রকল্পে আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১৯ শতাংশ, ভৌত অগ্রগতি ২৩ শতাংশ। এখনো অতিরিক্ত জনবল অনুমোদিত হয়নি।

শেষ পর্যন্ত ব্যয় ৪৮ কোটি ৬০ লাখ ৯ হাজার টাকা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যেও এর বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) নকশা পরিবর্তনের কারণে নির্মাণকাজসহ কিছু বিষয়ে ঝুঁকি বেড়েছে।
সূত্র জানায়, ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার আগেই প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে সচিবদের জন্য ভিভিআইপি কেবিন তৈরি করা হয়েছে। নিয়োগ হয়নি অভিজ্ঞ চিকিৎসক। চলমান প্রকল্প শেষ না করেই বিভাগীয় শহরগুলোতে একই ধরনের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের পরিচালক আবু আহমদ ছিদ্দীকী বলেন, চিকিৎসক ও কর্মীদের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে আছে। ভিভিআইপি কেবিনগুলো পরবর্তী সময়ে ওপরের তলায় সরিয়ে নেওয়া হবে। আট বিভাগেই সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’
হাসপাতালসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কারিগরি দক্ষতা না থাকায় বেড়েছে প্রকল্পের ব্যয় ও প্রশাসনিক জটিলতা। হাসপাতালের পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) মধ্যেও রয়েছে সমন্বয়হীনতা। এ কারণে দীর্ঘ সময় এই প্রকল্পের পিডি ছিল না।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে প্রকল্প শুরু হওয়ার ৯ মাস পর নিয়োগ পাওয়া প্রথম পিডি আবুল খায়ের মো. আক্কাস আলী মাত্র এক মাস দায়িত্ব পালন করেন। এরপর যুগ্ম সচিব মনিরুল ইসলাম পিডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে প্রকল্পে অনিয়মিত। অনেক কাজ চলে ভারপ্রাপ্ত পিডির মাধ্যমে। এমন প্রেক্ষাপটে গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবকে চিঠি দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ত্রুটিপূর্ণ ডিপিপির কারণে মূলত প্রকল্পে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্দেশে একই কাজ করতে হয়েছে সাত-আটবার। শুরুতে দেশীয় টাইলস বসানোর পরিকল্পনা থাকলেও পরে বিদেশি টাইলস ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে ডলারের সংকটসহ নানা কারণে এলসি খোলার পরও বিদেশি টাইলস আনতে দেরি হচ্ছে।

নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সের (এনডিই) কর্মকর্তারা বলেন, এখন নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছু জিনিসপত্র পাওয়া কঠিন।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতাশ : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-২ মোহাম্মদ আফজাল হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অগ্রগতি আশানুরূপ নয় উল্লেখ করে ধীর অগ্রগতির বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে। একই সঙ্গে অবশিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ানুগ পরিকল্পনা ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জানাতে বলা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আলী আজম। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, টাইলস, বাথরুম, ফ্লোর নকশাসহ কিছু বিষয় সংশোধিত ডিপিপিতে পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন এক হাজার ৭০০ জনবলের পদ সৃষ্টির কাজ চলছে। বিভিন্ন পদে ৪৫ জন চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে অর্ধেক চিকিৎসক চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। শূন্যপদে নিয়োগ চলমান।

গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আজমুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, টাইলস ও চিকিৎসার যন্ত্রপাতি কেনায় পরিবর্তন এসেছে। তাই প্রকল্পের কাজ শেষ করতে আরো সময় লাগতে পারে।

সরকারি কর্মচারী হাসপাতালকে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীতকরণ প্রকল্পের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী পরিকল্পনা কমিশন থেকে সংশোধিত ডিপিপি পাস হয়ে এসেছে। প্রকল্পের নকশা, যানবাহন, জনবলসহ বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে।

চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনা এবং অডিট না হওয়ার বিষয়ে পরিচালক বলেন, ‘এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছুই বলতে পারব না। তবে লাল ভবন ভাঙার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত আছে, ভবিষ্যতে ভাঙা হবে।’

অডিট হয়নি তিন বছর : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত তিন অর্থবছরে প্রকল্পের কোনো অডিট হয়নি। এতে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ইচ্ছামতো ব্যয় হচ্ছে প্রকল্পের টাকা। আবার অডিট না হওয়ায় অনিয়মগুলো নজরে আসেনি। আইএমইডি প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনেও উদ্বেগ জানিয়েছে।

সরকারি কর্মচারী হাসপাতালকে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীতকরণ প্রকল্পের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী পরিকল্পনা কমিশন থেকে সংশোধিত ডিপিপি পাস হয়ে এসেছে। প্রকল্পের নকশা, যানবাহন, জনবলসহ বেশ কিছু বিষয় পরিবর্তন আনা হয়েছে।

চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনা ও অডিট না হওয়ার বিষয়ে পরিচালক বলেন, ‘এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছুই বলতে পারব না। তবে লাল ভবন ভাঙার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত আছে, ভবিষ্যতে ভাঙা হবে।’

পরামর্শক নিয়োগ ও বাতিল : স্থাপত্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, একনেকের অনুমোদন ছাড়াই আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল নির্মাণের লক্ষ্যে ২০২০ সালে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই পরামর্শকের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এদিকে অনুমোদন ছাড়া পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ায় প্রকল্পের কাজ শেষ না হতেই তাঁর নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।

স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি মীর মনজুরুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালের নকশার প্রাথমিক কাজ স্থাপত্য অধিদপ্তর করেছিল। পরে বেসরকারি পরামর্শকের কাছ থেকে নকশা নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এতে কিছু জটিলতা হওয়ায় আবার স্থাপত্য অধিদপ্তর কাজ করেছে।

পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা চিকিৎসকদের : সারা দেশের সব হাসপাতালের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মহাপরিচালক (ডিজি) মাত্র একজন। অথচ সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের জন্যই একটি ডিজির পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আদলে অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিচালক ও উপপরিচালকের পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। প্রশাসনিক এই পদগুলোতে বেশির ভাগ দায়িত্ব পালন করবেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

চিকিৎসকদের অধ্যাপক পদটি তৃতীয় গ্রেডের। কিন্তু এই হাসপাতালের অধ্যাপকরা হবেন চতুর্থ গ্রেডের। প্রতি বিভাগে অধ্যাপকের পদ রয়েছে মাত্র একটি। নিচের পদেও চিকিৎসক কম। চিকিৎসকদের জন্য নেই পর্যাপ্ত আবাসিক ব্যবস্থা। এমন জনবল কাঠামো অনুমোদন দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

নতুন জনবল কাঠামোতে কার্ডিয়াক সার্জারি ও ক্যাথল্যাবের কোনো পদ নেই। কিন্তু কার্ডিয়াক সার্জারির সব সুবিধা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং সদস্যসচিব হলেন হাসপাতালের পরিচালক। দুজনই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করে সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক বলেন, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য আগে ভালো চিকিৎসকদের ভালো পরিবেশ দিতে হবে। কিন্তু এ হাসপাতালে চিকিৎসকদের বসার ভালো জায়গাই নেই। এক রুমে তিন-চারজন বসেন।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব ডা. এহতেশাম উল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এক পর্যায়ে দেখবেন, আমলাদের অধীনে কোনো চিকিৎসক চাকরি করবেন না। পুরো হাসপাতাল চালু হলে ভালো চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমার মনে হয়, তখন অপারেশন থিয়েটারেও আমলারা ভূমিকা রাখবেন।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/15/1227646