১৪ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ৯:২০

ঘাটতি মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই ছিল সরকারের শেষ ভরসা

২০২২ সালের মার্চ থেকে দেশে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে করে বিদায়ী বছর প্রতি ডলারের দাম বাড়ে প্রায় ২০ টাকা। তাতেও মেটেনি ডলার সংকট। এর ফলে বেড়ে গেছে টাকার চাহিদাও। ব্যাংকগুলোকে টাকা দিয়ে ডলার কিনে আমদানি বিল পরিশোধ করতে হয়। ফলে ডলার কিনতে গিয়েই অনেক ব্যাংক টাকার সংকটে পড়ে যায়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট দেখা দেয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বেছে নেয় সরকার। ফলে ঘাটতি মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই ছিল সরকারের শেষ ভরসা। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের ঋণ বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। এক বছরের ব্যবধানেই শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের দায় বেড়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ২১ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। ফলে ২০২২ সালের পুরো সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা।

২০২২ সালের একই সময়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৮০ হাজার ৯৬৪ কোটিতে। এক বছরের ব্যবধানে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ কমেছে ২৫ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। এদিকে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৬৫ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ধার করে সরকার।

বাজারে টাকার প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে সরকারের ট্রেজারি ব্যবস্থাপনার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের কৌশল নেয়। এছাড়াও ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা জমা দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার কিনে। এতে ব্যাংকগুলোতে তারল্যসংকট তৈরি হয়। এ জন্য সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ শোধ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণের বড় অংশ দিয়েছে ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে। অবশ্য গত ৬ মাসে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ অনেকটাই কমিয়ে আনে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কেননা তারল্যসংকটের কারণে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার বেড়ে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে টাকা বাজারে ছাড়ে, তার পুরোটাই রিজার্ভ মানি বা নতুন টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেয়, ব্যাংকগুলোকে ধার ও পুনঃ অর্থায়ন-সুবিধা দিয়ে থাকে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা বাইরে ছাড়ার অর্থ উচ্চমানের টাকা (হাই পাওয়ার) বাজারে ছাড়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ বেড়ে গেলে একদিকে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়, তাতে চাপ তৈরি হয় মূল্যস্ফীতির। ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার ফলে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি উভয়ই বাড়বে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিলে বেসরকারি ঋণ কমবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি বেশি ঋণ নিলে সরকার সাময়িক সময়ের জন্য উপকৃত হবে। তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। ব্যবসায় মন্দার কথা বলে ব্যবসায়ীদের অনেকেই কম কর দিচ্ছেন। সরকারের ব্যয়ও খুব বেশি কমছে না। একরকম বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। কারণ, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে যায়। নতুন করে কেনার চেয়ে সঞ্চয়পত্র ভেঙেছেন বেশি গ্রাহকেরা।

সাধারণত ঘাটতি বাজেটের জন্য সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রে জোর দেয়। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঘাটতি মেটাতে মোট ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ঋণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এই বিপুল অর্থের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। আর সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার সংগ্রহ করবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

এদিকে গত বছর জুড়েই ছিল ডলার সংকট। ডলারের বিপরিতে বেশ কয়েকবার টাকার মান হ্রাস পায়। আর ডলার কিনতে গিয়েই অনেক ব্যাংক টাকার সংকটে পড়ে। এছাড়াও ব্যাংকগুলো যে পরিমাণে ঋণ বিতরণ করেছে, আমানত জমা হয়েছে তার অর্ধেক। আমানতের সুদ মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হওয়ায় ব্যাংকে টাকা রাখার পরিমান কমে যায়। বছরের শেষ দিকে ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকের অনিয়ম আলোচনায় আসায় গ্রাহকদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে গত বছরের নভেম্বরেই পুরো ব্যাংক খাতের আমানত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা কমে যায়। এতে কিছু ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। মাঝেমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারেনি বেশ কিছু ব্যাংক। ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকের পাশাপাশি গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক চাহিদামতো সিআরআর রাখতে পারেনি।

মানুষ ব্যাংকে যে টাকা আমানত হিসেবে জমা রাখে, ব্যাংক তাই ঋণ হিসেবে বিতরণ করে থাকে। ব্যাংক খাতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর গত নভেম্বরে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে হয় ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ ও ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ফলে ব্যাংকে যে আমানত জমা হচ্ছে, তার চেয়ে ঋণ যাচ্ছে অনেক বেশি। আবার অনেকে খরচ মেটাতে সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন করে সঞ্চয়ও কমে এসেছে। আতঙ্কে অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে রাখছেন। এর ফলে গত ডিসেম্বরে শুধু একটি ইসলামি ধারার একটি ব্যাংকেরই আমানত কমেছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। ফলে সার্বিকভাবে আমানত কমে গেছে। গত অক্টোবরে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯০ হাজার ৪৩ কোটি টাকা, গত নভেম্বরে যা ৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা কমে হয় ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিব জানান, বাজারে তারল্যের ঘাটতি হবে এটার পূর্বাভাস ছিল। একক কোনো সিদ্ধান্তে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। কারণ, এটা ডলারের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে শুধু উৎপাদনশীল খাতকে বেছে নিতে হবে। আর তদারকি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাড়াতে হবে।

এদিকে ডলারের দাম বাড়ায় ডলার কেনা, রেমিট্যান্স কেনা, রপ্তানি বিল নগদায়নে গ্রাহকদের বাড়তি টাকা দিতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। আবার ব্যবসায় মন্দার কথা বলে ব্যবসায়ীরাও ঋণ পরিশোধ কমিয়ে দেন। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোতে তারল্যের ওপর চাপ তৈরি হয়। ২০২২ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে সব মিলিয়ে ১ হাজার ২৬১ কোটি ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতি ডলার ৯৮ টাকা ধরলে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। গত বছরে ব্যাংকগুলো থেকে এই টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভোল্টে। এতেও অর্থসংকট বেড়ে যায়।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদ কম। আবার ডলার কিনতে অনেক টাকা ব্যাংকে চলে গেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠন করে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি হতো। বাজারে কমবেশি সব ব্যাংকই তারল্যসংকটে ভুগেছে। টাকার জোগানদাতা ব্যাংকের সংখ্যা কমে গেছে। এ কারণে বাড়তি সুদে টাকা ধার করতে বাধ্য হয়েছে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক জানান, ট্রেজারি বিলে সুদ বেড়েছে, এ জন্য টাকা ধারের সব ধরনের পণ্যের সুদও বেড়েছে এটাই স্বাভাবিক। গত এক বছরে ডলার বিক্রির কারণে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে আসছে। এর ফলে তারল্যে সাময়িক অসামঞ্জস্য হতে পারে। ব্যাংকগুলো যে যেভাবে পারছে তারল্য ব্যবস্থাপনা করছে।

ব্যাংকগুলোর কাছে গত অক্টোবরে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য অতিরিক্ত তারল্য ছিল মাত্র ১২ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালের অক্টোবরে ব্যবহারযোগ্য তারল্য ছিল ৩৪ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুনে যা ছিল ৬৩ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। তবে গত অক্টোবরে দেশে ছাপানো টাকা বা রিজার্ভ মানির পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকে ও মানুষের হাতে ছিল ২ লাখ ৫৮ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। অক্টোবরে ব্যাংকের ভোল্টে নগদ টাকা ছিল ২১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকার, মানুষের হাতে ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকা।
ব্যাংকের তারল্যের বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, যারা ব্যাংক খাতে এই অবস্থার জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে জনগণের আস্থা কমে যাচ্ছে। এ জন্য ডলারের পর টাকার সংকট তৈরি হয়েছে। ছয় মাস ধরে সমস্যা চলছে, অথচ এটাকে কোনো সমস্যাই মনে করছে না সরকার। এখন সমাধান করতে হলে আগে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

https://dailysangram.com/post/513668