১৪ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ৯:১৫

ব্যাংকে ঋণের জালে সরকার

সরকারের ব্যাংক ঋণনির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে সরকার ক্রমেই ব্যাংক ঋণের বৃত্তে আটকা পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। সূত্রমতে, বিদায়ী বছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। যা আগের বছর ছিল ২ লাখ ২১ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে বছরের ব্যবধানে সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ৮১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকারের ব্যাংক ঋণস্থিতি ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসেই ঋণ বেড়েছে ৩২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। বিষয়টি অস্বাভাবিকই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক টাকা ছেপেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে টাকা থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। এতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেছে। বেড়েছে মূল্যস্ফীতিও। সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে দুর্ভোগ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপিয়ে সরকার ঋণ নিচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতি এবং মুদ্রাস্ফীতি উভয় বাড়ছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদায়ী বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। যা আগের বছর ছিল মাত্র ১৪ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা।

সে হিসাবে বছরের ব্যবধানে সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ঋণস্থিতি ছিল ৫৫ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। সূত্রমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসেই (জুলাই-ডিসেম্বর) ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। যদিও আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণের অঙ্ক ছিল মাত্র ২৪ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছর এবং অর্থবছর-সব হিসাবেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার অঙ্ক অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি। উল্টো আগের ঋণ থেকে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল। অথচ চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। জানা গেছে, উন্নয়ন কাজের ব্যয় বা বাজেট বাস্তবায়নের জন্য যে কোনো সময় ট্রেজারি বন্ড বা ট্রেজারি বিল ইস্যু করতে পারে সরকার। এর বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ ধার নিয়ে তার ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু ঋণের বিপরীতে বাজারভিত্তিক সুদের হার না থাকা ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিকে ঝুঁকেছে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সরকারকে ঋণ বাড়িয়ে না দেয়, তাহলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ড কেনার দিকে মনোযোগী হবে। এতে দেশের ঋণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে ব্যাংকিং খাতে অনাকাক্সিক্ষত জটিলতা দেখা দিতে পারে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগে সুদহার প্রায় ৯ শতাংশ বা তার বেশি এবং এতে কোনো ঝুঁকিও থাকে না। অপরদিকে ঋণ বিতরণ ও উত্তোলনে ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকি নিতে হয়। তাই ব্যাংকগুলোকে যদি অধিক পরিমাণে বিল ও বন্ড কেনার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে তারা শূন্য ঝুঁকির বিল আর বন্ডই কিনবে। অপরদিকে ঋণ বিতরণ কমিয়ে দেবে। এতে দেশের শিল্পখাত ক্ষতির মুখে পড়বে।

এমতাবস্থায় সরকারকে ব্যাংক ঋণ না নিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা অনুসন্ধান করা দরকার। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও সীমাবদ্ধতা আছে। তাই সরকারের ঋণ যাতে সীমা অতিক্রম না করে সেদিকে সংশ্লিষ্ট সকলকে মনোযোগী হওয়া দরকার। আর টাকা ছাপিয়ে সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে একটি ভারসাম্যপূর্ণ মুদ্রানীতিও সময়ের দাবি। অন্যথায় জাতীয় অর্থনীতিতে কোন শৃঙ্খলা থাকবে না; সৃষ্টি হবে জনদুর্ভোগও।

https://dailysangram.com/post/513598