১৩ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ৭:৩১

ব্রয়লার মুরগিতে সহনীয় মাত্রায় ভারী ধাতু

বাজারে প্রচলিত ব্রয়লার মুরগির মাংসে ভারী ধাতু থাকলেও এর মাত্রা শরীরের জন্য সহনীয়। খোলা বাজারের তুলনায় সুপারশপের মুরগির মাংসে ভারী ধাতুর উপস্থিতি কম। সব দিক থেকে ব্রয়লার মুরগির মাংস একটি নিরাপদ খাদ্য। এই মাংসে জনস্বাস্থ্যের জন্য কোনো ঝুঁকি নেই।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সচিবালয়ে তথ্য অধিদপ্তরের সম্মেলনকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক। এ সময় ব্রয়লার মুরগির মাংস খাওয়া নিরাপদ কি না এবিষয়ক গবেষণার ফলাফল নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি মতবিনিময় করেন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অধীনে গবেষণাটি গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগির মাংস, হাড় ও কম্পোজিটে মূলত দুটি অ্যান্টিবায়োটিক (অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ও ডক্সিসাইক্লিন) এবং তিনটি হেভি মেটালের (আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেড) সামান্য উপস্থিতি রয়েছে। এসব ভারী ধাতু অস্বাভাবিক নয় এবং তা সর্বোচ্চ সহনশীল সীমার অনেক নিচে।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক সময় ব্রয়লার মুরগির মাংস সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্রয়লার মাংস খাওয়া কমিয়ে দেয়। এতে ব্রয়লার শিল্পের ওপর একটি বড় ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ব্রয়লার মুরগির মাংস, হাড় ও কম্পোজিটে (কলিজা, কিডনি ও গিজার্ডের সমন্বয়) এবং মুরগির খাদ্যে কী পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতু আছে তা নির্ণয়ে গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ও উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অধীনে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।

জানা গেছে, বাংলাদেশের পাঁচটি জেলা শহরের (ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশাল) ব্রয়লার মুরগির খামার (ছোট, মাঝারি ও বড়) এবং বাজার থেকে মাংস, হাড় ও কম্পোজিট এবং ব্রয়লার খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ঢাকার তিনটি সুপারশপ থেকেও ব্রয়লার মুরগির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। প্রায় এক হাজার ব্রয়লার মুরগি এবং ৩০টি ব্রয়লার মুরগির খাদ্য থেকে ৩১৫টি নমুনা প্রস্তুত করে বহুল ব্যবহৃত ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক ও তিনটি ভারী ধাতুর অবশিষ্টাংশের পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়।

দশটি অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে সাতটি অ্যান্টিবায়োটিক (এনরোফক্সাসিন, সিপরোফ্লক্সসিন, নিওমাইসিন, টাইলোসিন, কলিস্টিন, এমোক্সাসিলিন এবং সালফাডায়াজিন) পরীক্ষার জন্য নমুনা সব এসজিএসের মাধ্যমে ভারতের চেন্নাইয়ে পাঠানো হয়। বাকি তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক (ক্লোরামফেনিকল, অক্সিটেট্রাসাইক্লিন এবং ডক্সিসাইক্লিন) এবং তিনটি ভারী ধাতু (আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেড) পরীক্ষার জন্য নমুনা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীন আধুনিক উন্নত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়।

গবেষণার ফলাফল বিস্তারিত তুলে ধরে কৃষিমন্ত্রী জানান, ব্রয়লার মাংসে গড়ে ৮.০ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ৯.১ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ৬.২ পিপিবি আর্সেনিক, ১৯০.৭ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ২৫৯.১ পিপিবি লেড আছে। এসব ভারী ধাতু সর্বোচ্চ সহনশীল/অবশিষ্ট সীমার চেয়ে যথাক্রমে ১২.৫ গুণ, ১০.৯ গুণ, ৬.৫ গুণ, ৫.২ গুণ ও ২৩.১ গুণ নিচে আছে।

ব্রয়লার মুরগির হাড়ের নমুনা পরীক্ষা করে ফলাফলে দেখা যায়, গড়ে ৫৩.৭ পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ২৭.০ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ৭.২ পিপিবি আর্সেনিক, ৪৩৯.৯ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ৪৬৪.৬ পিপিবি লেড রয়েছে। এই মাত্রা সর্বোচ্চ অবশিষ্ট সীমার চেয়ে যথাক্রমে ১.৮ গুণ, ৩.৭ গুণ, ৫.৫ গুণ, ২.২৭ গুণ এবং ১২.৯ গুণ নিচে।

ব্রয়লার মুরগির কম্পোজিটে (কলিজা, কিডনি ও গিজার্ডের সমন্বয়) গড়ে ১৪.৫ পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ১৭.২ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ১০.৯ পিপিবি আর্সেনিক, ২৩৯.২ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ৩০৭.৬ পিপিবি লেড রয়েছে। এটি সর্বোচ্চ অবশিষ্ট সীমার চেয়ে যথাক্রমে ৬.৮ গুণ, ৫.৮ গুণ, ৩.৬ গুণ, ৪.১৮ গুণ এবং ১৯.৫ গুণ নিচে।

বাজার ও খামার থেকে সংগৃহীত ব্রয়লার মুরগির খাদ্যে গড়ে ০.৮ পিপিবি অক্সটেট্রাসাইক্লিন, ১৯.২ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ৪.১৯ পিপিবি টাইলোসিন, ৭.৬ পিপিবি আর্সেনিক, ২১৫৩.৩ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ৪৭৮.৬ পিপিবি লেড রয়েছে, যা আর্সেনিকের ক্ষেত্রে ১৮৪.২ গুণ, ক্রোমিয়ামের ক্ষেত্রে ৯.২ গুণ এবং লেডের ক্ষেত্রে ২০.৮ গুণ সর্বোচ্চ অবশিষ্ট সীমার চেয়ে নিচে।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, উন্নত বিশ্বে একজন মানুষ বছরে প্রায় ৭২ কেজি মাংস খাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ খাচ্ছে ২৭ কেজি। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকলেও সচেতনতার অভাবে তা বাড়ানো যাচ্ছে না।

মন্ত্রী আরো বলেন, “দেশে মাথাপিছু মুরগির মাংস খাওয়ার পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব কম। এর কারণ ফার্মের মুরগির মাংস সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষের নেতিবাচক ধারণা। ফার্মের মুরগির মাংসের স্বাদ কম। অনেক উচ্চবিত্ত মনে করে, এটা গরিবের মাংস। তথাকথিত অনেক অভিজাত শ্রেণি অহংকার করে বলে, ‘আমরা ফার্মের মুরগি খাই না।’ দেশে ব্রয়লার মুরগি খুবই সম্ভাবনাময় একটি খাত। এ জন্য মানুষের কাছে মুরগির মাংস জনপ্রিয় করতে হবে।”

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/13/1225987