১৩ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ৭:২৮

যানজটে স্থবির রাজধানী

সড়কে ঘুরছে না চাকা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় একই জায়গায়। অফিসমুখী মানুষ যথাসময়ে পৌঁছতে পারেনি কর্মস্থলে। বিলম্বে ছেড়েছে ফ্লাইট। সব মিলিয়ে গতকাল যানজটে নাকাল ছিল রাজধানীবাসী। সকাল থেকে মহাখালী থেকে বিমানবন্দর-উত্তরা হয়ে গাজীপুর পর্যন্ত এমন চিত্র দেখা যায়। বিকালের দিকেও এ জট কমেনি। যানজটের পরিস্থিতি সামাল দিতে আন্তঃজেলা বাসগুলো মহাখালী থেকে ঘুরিয়ে দিতেও দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশকে। বিমানবন্দর সড়কের উন্নয়নমূলক কাজ এবং ইজতেমার কারণে ইপিজেড-আশুলিয়া-টঙ্গী সড়ক বন্ধ করে দেয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে মহাখালী থেকে বিমানবন্দর সড়ক ও উত্তরামুখী মানুষের কষ্টের অন্ত ছিল না।

বিমানবন্দর এলাকায় তীব্র যানজটের প্রভাব ছিল ফার্মগেট, শাহবাগ, মিরপুরের কালসী, তেজগাঁও, কাওরান বাজার, বনানী, মালিবাগ, বাড্ডা, কুড়িল বিশ্বরোড, নতুন বাজার, প্রেস ক্লাব, পল্টন, মতিঝিল, কমলাপুর, নিউমার্কেটসহ রাজধানীর অন্যান্য সড়কগুলোতেও। বাদ যায়নি পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো। সরজমিন দেখা যায়, যানজটের কারণে মানুষ রাস্তায় বের হয়ে তীব্র ভোগান্তিতে পড়েছে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে থেকেও গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি অনেকে। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ বাসায় ফিরেছেন। কর্মস্থলেও যথাসময়ে পৌঁছতে পারেনি অফিসমুখী মানুষ। সকালের তুলনায় বিকেলে যানজট কিছুটা কমলেও ভোগান্তি কমেনি মানুষের। রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও বাসে উঠতে পারছিলেন না অনেকে। পায়ে হেঁটে বাসার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছেন অনেকে। ট্রাফিক পুলিশ জানায়, টঙ্গীর ইজতেমাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসল্লিরা এরই মধ্যে ইজতেমা ময়দানে জড়ো হতে শুরু করেছেন। কেউ বাসে করে, কেউবা বিভিন্ন ছোট-বড় যানবাহনে করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসছেন। কিন্তু তাদের বহনকারী পরিবহনগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার কারণে যান চলাচল ব্যাহত হয়। যারা উত্তরার দিকে যাচ্ছেন, তাদের বিভিন্ন সড়কে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ২ কিলোমিটার জায়গা অতিক্রম করতে সময় লেগেছে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে রাজধানীজুড়ে। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে উত্তরাগামী যানবাহন এবং যাত্রীদের দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে দেখা যায়। যানজটের কারণে দীর্ঘ অপেক্ষায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। প্রজাপতি পরিবহনের এক চালক বলেন, উত্তরা থেকে যখন আসি, তখন দীর্ঘ যানজটে পড়ে থাকতে হয়।

রাস্তার পাশে অনেক গাড়ি পার্ক করা ছিল। যারা ইজতেমায় এসেছে, তাদের গাড়ি রাস্তায় পার্ক করার কারণে যাতায়াতের রাস্তা ছোট হয়ে যায়। সে কারণেই যানজটের সৃষ্টি হয়। ট্রাফিক উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) কামরুজ্জামান বলেন, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে দেশ ও বিদেশে থেকে হাজার হাজার মুসল্লি তুরাগ নদীর পাড়ে এসে হাজির হচ্ছেন। এর কারণে সড়কে চাপ বেড়েছে। গাজীপুরে আবার এক লেনে চলছে দুই লেনের গাড়ি। ফলে বিমানবন্দর এলাকা থেকে উত্তরার দিকে বা গাজীপুরের দিকে চলাচলে বাড়তি সময় লাগছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের বহনকারী পরিবহন সড়কে চাপ তৈরি করেছে। এই চাপ ইজতেমা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। সেজন্য এই সড়কে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া চলাচল না করার অনুরোধ জানান তিনি।

ইজতেমার কারণে বুধবার সকাল থেকে টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের ঢাকার প্রবেশমুখ বাইপাইল এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের রেকার ট্রাক দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়। আশুলিয়ার বাইপাইল ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) মো. জাহিদ হোসেন বলেন, ইজতেমার কারণে এই সড়কটিতে চাপ বেড়ে যাওয়ায় মুসল্লিদের ইজতেমা ময়দানে যেতে সমস্যা হচ্ছে। তাই আপাতত এই সড়কটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বেড়িবাঁধ ও কামারপাড়ার দিকে চাপ কমে গেলে সড়ক স্বাভাবিক করে দেয়া হবে। দাউদ খান নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, যানজটের কারণে যথাসময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারিনি। উত্তরার জসিমউদ্দীন এলাকার বাসিন্দা ইমরান হাসান জানান, অনেকদিন ধরেই উত্তরাবাসী ভুগছে যানজটে। আজ বের হয়ে টের পেয়েছি কপালে বাড়তি ভোগান্তি আছে। ২ ঘণ্টায় মহাখালী পৌঁছেছি। ভিক্টর ক্লাসিকের এক বাসচালক বলেন, কুড়িল বিশ্বরোড পার হয়ে কোনোভাবে বিমানবন্দর এলাকায় এসেছি। এখানে ১ ঘণ্টা ধরে আটকে আছি। এখন আর গাড়ি সামনে যাচ্ছে না। দুপুরে তেজগাঁও ও শিল্পাঞ্চল এলাকায় দেখা যায়, সব লেনেই অতিরিক্ত গাড়ির চাপ। দুই লেনে একসঙ্গে ডাইভারশন করে মাঝে দাঁড়িয়ে যান চলাচল অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছেন ট্রাফিক সদস্যরা। তবুও সড়কে যানবাহনের দীর্ঘ সারি তৈরি হয়েছে।

বিজয় সরণিতে দেখা যায়, অতিরিক্ত সময় লাগছে একেক লেনের গাড়ি ছাড়তে। মহাখালী, কুড়িল বিশ্বরোড, নর্দা, নতুন বাজার ও বাড্ডা এলাকায় সরজমিন দেখা গেছে, কয়েকশ’ মানুষ যানবাহনের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। তীব্র যানজটের কারণে গণপরিবহন থেমে থাকায় তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। অনেককে হেঁটেই গন্তব্যের দিকে রওনা দিতে দেখা গেছে। যানবাহনের এই সংকটের প্রভাব পড়েছে বনানী ও গুলশান এলাকাতেও। গোলাম মহিউদ্দিন নামে এক যাত্রী বলেন, সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে বনশ্রী থেকে বাড্ডা এলাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। রাস্তায় নেমেই দেখি গাড়ি নেই, শত শত যাত্রী রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। অনেক কষ্টে বনশ্রী থেকে আসমানী পরিবহনে উঠলেও রামপুরা ব্রিজ থেকে নামিয়ে দেয়। এরপর তুরাগ পরিবহনে উঠে মেরুল বাড্ডা পর্যন্ত এলেও বাড্ডা লিংক রোড হেঁটে আসতে বাধ্য হয়েছি। শুধু আমিই না আমার মতো এমন শত শত যাত্রী পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যাচ্ছেন। এদিকে তীব্র যানজটের কারণে অনেক যাত্রী যথাসময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পারেনি। অনেকে মুঠোফোনে ফ্লাইট বিলম্বে ছাড়ার অনুরোধ করেন। এমন কি যানজটে আটকা পড়েছেন পাইলট ও ক্রু’রা।

বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, ৩০টির অধিক ফ্লাইট যথাসময়ে উড্ডয়ন করতে পারেনি। এমন অবস্থায় বিমানযাত্রীদের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সের এক কর্মকর্তা বলেন, সকাল ৯টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রুটের ফ্লাইটে ৫৩ জন যাত্রী ছিল। তাদের মধ্যে ২৭ জনই ফোন করে ফ্লাইট পৌঁছাতে অনুরোধ করেছেন। বাধ্য হয়ে ফ্লাইটটি প্রায় পৌনে ২ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে। শুধু তাই না, সকাল থেকে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটের অধিকাংশ ফ্লাইটই এক থেকে দেড় ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটের ক্রুদের বহনকারী বাস যথাসময়ে না পৌঁছানোয় ৩ ঘণ্টা বিলম্বে উড্ডয়ন করেছে বলে জানা গেছে। ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম জানান, যানজটের কারণে সকাল বিভিন্ন ফ্লাইটের যাত্রীদের বিমানবন্দরে আসতে সমস্যা হচ্ছিলো। তাদের দ্রুত বিমানবন্দরে পৌঁছানোর জন্য এপিবিএন ও ট্রাফিক পুলিশের সহযোগিতা চাওয়া হয়।

https://mzamin.com/news.php?news=38177