গ্রাহক পর্যায়ে আবারও বাড়ল বিদ্যুতের দাম। এবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে বিদ্যুতের খুচরা দাম ইউনিটপ্রতি ১৯ পয়সা বাড়িয়েছে সরকার।
শতাংশ হিসাবে বৃদ্ধির এই হার ৫ শতাংশ। ১ জানুয়ারি থেকে নতুন দাম কার্যকর হবে। একই সঙ্গে এখন থেকে প্রতিমাসে বিদ্যুতের খুচরা দাম নিয়মিত সমন্বয় করা হবে। বৃহস্পতিবার সরকারের এক নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়।
সন্ধ্যায় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। দাম বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিবিষয়ক প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বেড়ে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা, শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ১৯ পয়সা থেকে ৪ টাকা ৪০ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৫ টাকা ৭২ পয়সা থেকে ৬ টাকা ১ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা থেকে ৬ টাকা ৩০ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৩৪ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৬৬ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ৯ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৪৪ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১১ টাকা ৪৯ পয়সা থেকে বেড়ে ১২ টাকা ৩ পয়সা করা হয়েছে।
এছাড়া সেচে ৪.১৭ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪.৩৭ টাকা। ক্ষুদ্রশিল্পে ৮.৫৩ টাকা থেকে ৮.৯৬ টাকা, নির্মাণে ১২ টাকা থেকে ১২.৬০ টাকা, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ৬.০২ টাকা থেকে ৬.৩২ টাকা, রাস্তার বাতিতে ৭.৭০ টাকা থেকে ৮.০৯ টাকা, বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ১০.৩ টাকা থেকে ১০.৮২ টাকা এবং শিল্প গ্রাহকদের ৮.৪৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮.৮৭ টাকা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ভর্তুকি সমন্বয় করতে বিদ্যুতের মূল্য শতকরা ৫ ভাগ সমন্বয় করা হয়েছে। লাইফলাইন গ্রাহকদের ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৭৫ পয়সার স্থলে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা দিতে হবে, অর্থাৎ ইউনিটপ্রতি ১৯ পয়সা বাড়বে। লাইফলাইন গ্রাহক রয়েছেন ১ কোটি ৬৫ লাখ।
দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের স্বল্পতার কারণে আমদানীকৃত তরল গ্যাসের ব্যাপক ব্যবহার, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকা মানের অবমূল্যায়নের কারণে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন কর্তৃক ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে প্রায় ২০ শতাংশ বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে।
বিতরণ কোম্পানিগুলো পাইকারি পর্যায়ে প্রায় ২০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে তাদের আর্থিক ক্ষতি পূরণের জন্য অন্তত ১৫.৪৩ শতাংশ খুচরা/ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির জন্য আবেদন করে। দেশের সার্বিক আর্থিক অবস্থা বিবেচনায়, বিতরণ কোম্পানিগুলোর আবেদনের বিপরীতে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য ৫ শতাংশ সমন্বয় করা হয়েছে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে খুচরা মূল্যের ভরিত গড় ৭.১৩ টাকা থেকে বেড়ে ৭.৪৯ টাকা হবে।
এর আগে রোববার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ওপর গণশুনানির আয়োজন করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তাতে বিদ্যুৎ বিতরণকারী ছয়টি প্রতিষ্ঠান/সংস্থা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব উত্থাপন করে। ওই শুনানিতে বিদ্যুতের দাম ১৫.৪৩ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছিল বিইআরসির কারিগরি কমিটি। কিন্তু বিইআরসি সিদ্ধান্ত জানানোর আগেই সরকার নির্বাহী আদেশে দাম বাড়িয়ে দিল।
উল্লেখ্য, কয়েকদিন ধরে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিইআরসি এবং বিদ্যুৎ বিভাগে নানা খবর শোনা যাচ্ছিল। ৮ জানুয়ারি বিইআরসি গণশুনানির আগে মন্ত্রণালয়ের মতামত নেয়। মন্ত্রণালয় তখন বিইআরসিকে শুনানি করে দাম বৃদ্ধি করার অনুমোদন দেয়।
কিন্তু ৮ জানুয়ারি শুনানির পর মন্ত্রণালয় থেকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিইআরসি এই পরামর্শ বাস্তবায়নে অপারগতা প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়কে জানায়, ১৫ জানুয়ারি শুনানি-পরবর্তী মতামত দেওয়ার সময় বেঁধে দিয়েছে তারা। এর আগে দাম বৃদ্ধি করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নির্বাহী আদেশে এভাবে তড়িঘড়ি করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনা নজিরবিহীন। আইএমএফ’র দেওয়া শর্ত পূরণের অংশ হিসাবেই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষ করে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের বিবেচনাধীন অবস্থায় থাকা বিদ্যুতের দাম নির্বাহী আদেশে বাড়ানোর খবরে অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
কয়েক বছর ধরেই বিইআরসি বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের কাজ করে আসছিল। সম্প্রতি বিইআরসি আইনের সংশোধনী এনে বিইআরসির পাশাপাশি নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর ধারা যুক্ত করা হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে দাম ৫.৭৭ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় দেশের মানুষের জীবনযাপনের খরচ আরও বাড়বে। এমনিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে। চালের দাম বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফা। বেড়েছে চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ ও রসুনের দাম। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতিও বেড়ে চলছে। সব মিলিয়ে মধ্যম ও নিম্ন-আয়ের মানুষ যখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখনই বিদ্যুতের দাম বাড়াল সরকার।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর সূত্রে জানা যায়, পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর করণে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ এবং অফগ্রিড এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে গিয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর ব্যয় বেড়ে গেছে। পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগেই ২০২১-২২ অর্থবছরে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ৫২৪ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে লোকসান হবে ১১২৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর থেকে বাড়তি বিল দিতে হচ্ছে তাদের। এ খাতে বছরে ৪৭৪০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে যাবে। এ কারণে দাম বাড়ানোর বিকল্প ছিল না সরকারের হাতে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিইআরসির একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে দাম বাড়াতে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। বিদ্যুৎ বিভাগ বিলিং মাস জানুয়ারি থেকেই নতুন দর কার্যকর করতে চাচ্ছিল। আরইবিসহ কোনো কোনো সংস্থা ১০ তারিখের মধ্যেই বিল তৈরির কাজ শুরু করে।
সেসব গ্রাহকের বিল আদায়ে সমস্যা হতে পারে। ফেব্রুয়ারির বিলের সঙ্গে জানুয়ারির বর্ধিত বিল আদায় করতে গেলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ কারণে ১৫ জানুয়ারির আগেই আদেশ দিয়ে বিল আদায়ের জটিলতা এড়াতে এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে সরকার।
২০২০ সালের আগে ২০১৭ সালের নভেম্বরে পাইকারি বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়েছিল সরকার, যা ওই বছর ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়।
বিদ্যুতের এই দাম বাড়ার প্রভাব কেবল বাসাবাড়িতে পড়বে তা নয়, কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচও এতে বৃদ্ধি পাবে। উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরাও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে হতাশার কথা জানিয়েছেন। এমনিতে সামগ্রিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। বেশির ভাগ সূচকই নিম্নগামী। বিশ্ব অর্থনীতিও মন্দার আশঙ্কায়। কমে যাচ্ছে সামগ্রিক চাহিদা। এরকম একসময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কতটা সময়োপযোগী, এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন উদ্যোক্তারা।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো দরকার ছিল না। পাইকারি বিদ্যুতে পিডিবি মুনাফা করছে ৫০০ কোটি টাকা, কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে তাদের মুনাফা করার সুযোগ নেই।
এরকমভাবে সুনির্দিষ্ট খাত উল্লেখ করে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার অযৌক্তিক ব্যয় দেখানো হয়েছিল। সুনির্দিষ্ট এসব অযৌক্তিক ব্যয় কমানো গেলে দাম বাড়ানোর দরকার হতো না। অযৌক্তিক ব্যয় আমলে না নেওয়ার কারণ হিসাবে শামসুল আলম বলেন, মূলত বিদ্যুৎ খাতে যে লুটপাট চলছে, তা অব্যাহত রাখতে অযৌক্তিক ব্যয় থেকে সরে আসার চেষ্টা করেনি বিইআরসি।
বিদ্যুতের দাম বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ইতোমধ্যে পোশাকশিল্প খাত ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। দেশের শীর্ষ পণ্য রপ্তানির পোশাকশিল্প যে কোনো সময়ের চেয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।