১৩ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ৭:১০

মেধাপাচার ও মেধা সঞ্চালন

-ইবনে নূরুল হুদা

মেধা ব্যক্তির অতিগুরুত্বপূর্ণ মানবীয় গুণ। এক অর্থে মেধাকে প্রতিভাও বলা হয়। ব্যক্তির সুপ্তপ্রতিভার বিকাশ ও স্ফূরণ ঘটে সুশিক্ষার মাধ্যমে। আর সুশিক্ষিত ও প্রতিভাবান জনগোষ্ঠীই দেশ ও জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই মেধাবীদের কাজে লাগানো এবং তাদের যথাযথ মূল্যায়নও জরুরি হলেও এক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই উদাসীন। সঙ্গত কারণেই দেশ থেকে মেধাপাচার হচ্ছে অবলীলায়।

মেধাপাচার মানুষের অভিবাসন প্রক্রিয়ার একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন কিংবা শিক্ষিত মেধাবীদের বিরাট অংশের অভিবাসন অথবা অন্যদেশে গমনের ফলশ্রুতিতে মেধাপাচার ঘটছে। সাধারণত যুদ্ধ, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা জীবন যাপনের ঝুঁকির এড়াতে মেধাপাচার একটি চলমান প্রক্রিয়া। মেধা পাচারের কারণে একটি দেশ তার সবচেয়ে মেধাবী, জ্ঞানী, দক্ষ ও যোগ্য নাগরিককে হারায়। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোও দুর্বল হয়ে পড়ে।

বৃটেনের রয়েল সোসাইটি মেধাপাচার বলতে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের উত্তর আমেরিকা অথবা ইউরোপে অভিবাসনকে বুঝিয়েছে। মেধাপাচারের বিপরীত শব্দ হল মেধা আহরণ। এটা হয় যখন কোন দেশে বহু সংখ্যক দক্ষ লোকের আগমন ঘটে। যোগ্য ও অভিজ্ঞ লোকদের তাদের যোগ্যতা প্রমাণে সুযোগ দিয়ে এবং জীবনযাত্রার অন্যান্য সুবিধাদি বৃদ্ধি করে মেধাপাচার রোধ করা যায়। মেধাপাচার উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বেশি দেখা যায় যেমন আফ্রিকার কলোনিগুলো, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া। আমাদের দেশও এ তালিকার বাইরে নয়।

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমাদের দেশ থেকে প্রতিনিয়তই মেধাপাচার এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সেই সাথে পাচার হচ্ছে প্রভূত অর্থও। প্রতি বছর গড়ে অর্ধলক্ষ ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। তাদের অধিকাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অন্তত ৫৭টি দেশ। কেউ যাচ্ছেন পিএইচডি ডিগ্রি করতে; আবার কেউ মাস্টার্স বা অনার্স ডিগ্রি নিতে। বিদেশে যাওয়া এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে যাদের দেশে ভালো চাকরির নিশ্চয়তা রয়েছে কেবল তারাই ফিরে আসছেন। অধিকাংশ আর ফিরছেন না। তারা সংশ্লিষ্ট দেশে চাকরি নিয়ে স্থায়ী আবাস গড়ছেন। এভাবে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে মেধা। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তৈরি করা মেধাবীর সেবায় উন্নত হচ্ছে অন্য দেশ। বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। যা রীতিমত আত্মঘাতী ও উদ্বেগের।

বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ আছে দুর্নীতিবাজদের সন্তান। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার নামে তারা অনেকেই বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন বৈদেশিক মুদ্রা। ওই টাকায় সংশ্লিষ্ট দেশে গাড়ি-বাড়ি কিনে কিংবা ব্যবসায়ী সেজে স্থায়ী বসবাসের (পিআর) অনুমতি নিচ্ছেন। এরপর শুরু হয় তাদের উচ্চাভিলাষী ও বিলাসবহুল জীবনযাপন। অবশ্য বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই ‘ফান্ডিং’ (ভর্তি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে খ-কালীন চাকরি) কিংবা ‘মেধাবৃত্তি’ নিয়ে পড়তে যান। আবার বাবা-মায়ের সর্বশেষ সম্বল বিক্রি করে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো দেশের উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য ও দক্ষ অংশ যখন অন্য দেশে চলে যায় এবং সেখানেই চাকরি করে; ফিরে আসে না সেটাকে মেধা পাচার বা ব্রেইন-ড্রেইন বলা হয়। উন্নত প্রযুক্তি ও পরিবেশে লেখাপড়া-গবেষণা আর বৈশ্বিক জ্ঞানভা-ারের সঙ্গে পরিচিত হতে বিদেশে উচ্চশিক্ষার্থে যাওয়াটা অপরাধ নয়, বরং বেশ জরুরি। তবে এদের দেশে ফেরৎ না আসাটা রীতিমত দুর্ভাগ্যজনক। অথচ তারা ফিরে এসে দেশের জনশক্তিকে বৈশ্বিক মানে তৈরি করতে পারেন। চীন-ভারত প্রতি বছর হাজার হাজার গ্রাজুয়েটকে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা-যুক্তরাজ্যসহ উন্নত দেশে পাঠাচ্ছে। এজন্য তাদের বিনিয়োগের আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাও আছে। ব্যবস্থা রয়েছে ব্যাংক ঋণ প্রাপিত্তরও। তবে আমাদের চেয়ে ব্যতিক্রম হচ্ছে-যারা পড়তে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগ আবার ফিরে এসে নিজ দেশে সেবা করছেন।

এ ছাড়া যারা ওইসব দেশে থেকে যাচ্ছেন এবং উচ্চপদে চাকরি করছেন-তাদের যথাযথ সুযোগ দিয়ে ফিরিয়ে এনে নিজের দেশ গড়ার কাজে নিযুক্ত করছে। সুতরাং সমস্যাটা বিদেশযাত্রায় নয়- ফিরে না আসায় এবং দেশে যথাযথ সম্মান না পাওয়ার ক্ষেত্রে। তাই মেধাবীরা কেন ফিরছে না বা কেন দেশ তাদের ফিরিয়ে আনতে পারছে না-সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে।

মূলত, দেশের মেধাবীরা বিদেশে পড়তে গেলে মোটা দাগে তিনটি ক্ষতি হয় দেশের। একটি হচ্ছে, জাতি তার যোগ্যতর সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যারা ফিরে আসে না তারা দেশে কোনো অর্থ পাঠান না। বরং অনেকে নিজের সহায়-সম্বল যা আছে তা বিক্রি করে চলে যান। যা কোনভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। শেষটি হচ্ছে, তাদের মাধ্যমে এ দেশ থেকে দুর্নীতিবাজ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ অন্যরা বিদেশে টাকা পাচার করেন। এই অর্থের বড় অংশ যায় অনানুষ্ঠানিক (হুন্ডি) পথে। ফলে ‘রিজার্ভ’ সঙ্কটে পড়ে দেশ। অন্যদিকে শ্রমিকরা বিদেশ গেলে অর্জিত অর্থ (ডলার) আনুষ্ঠানিক বা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পাঠান।
জানা গেছে, আমাদের দেশ থেকে যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের বড় অংশ মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে যারা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশে যান তাদের অন্তত ৭০ শতাংশ ফিরে আসেন না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তাদের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। দেশে গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি হলে খুব কম সংখ্যক হয়তো যেতেন। যা ভারত, চীন এবং মালয়েশিয়ায় দেখা যায়। অন্যদিকে বিত্তবানরা তাদের সন্তানদের স্নাতক করতে পাঠান যখন ভালো বিশ্ববিদ্যালয় বা বিষয়ে চান্স পায় না। সাম্প্রতিক সময়ে একটি অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে-বিদেশে পাঠানো সন্তানের লেখাপড়ার নামে অনেকেই বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করছেন। যা আমাদের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলছে।

সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, বিদেশে যেসব বাংলাদেশী লেখাপড়া করতে যান তাদের একটি বড় অংশ মাস্টার্স আর পিএইচডি করতে যান। এই তালিকায় কেবল বুয়েটেরই প্রতি ব্যাচের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী আছেন। লেখাপড়া শেষে তাদের খুব কম অংশই দেশে আসেন। এই তালিকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষার্থীই বেশি। বিজনেস স্টাডিজের কিছু শিক্ষার্থী আছেন। আর কলা-সামাজিকবিজ্ঞানে ইংরেজি-অর্থনীতির মতো বিষয়ের শিক্ষার্থী আছেন। এছাড়া একটি অংশ আন্ডারগ্রাজুয়েট বা অনার্স ডিগ্রি করতে যান। তাদের খুব কমসংখ্যকই দেশে ফিরে আসেন।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থার (ইউনেস্কো) ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশে লেখাপড়া করতে যাওয়া সংক্রান্ত একটি চিত্র পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো এবং ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন ইনস্টিটিউট যৌথভাবে ‘ওপেন ডোরস রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জ’ নামে প্রতিবেদনেও এ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। ইউনেস্কো বলছে, ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষে বিশ্বের ৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৪৯ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য গেছেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেই গেছেন সর্বাধিক ৮৬৬৫ জন। দ্বিতীয় স্থানে আছে মালয়েশিয়া। সেখানে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৫৪৮ জন। শীর্ষ ১২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ভর্তির তৃতীয় ও চতুর্থ সর্বোচ্চ দেশ দুটি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা।

দেশ দু’টিতে যথাক্রমে ৫৬৪৭ ও ৫১৩৬ জন পড়তে গেছেন। বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের পছন্দের পঞ্চম আর ষষ্ঠ স্থানে আছে জার্মানি ও যুক্তরাজ্য। দেশ দু’টিতে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৯৩০ ও ৩১৯৪ জন। সপ্তম থেকে দ্বাদশ স্থানে থাকা দেশগুলো হচ্ছে-ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, সুইডেন, সাইপ্রাস, এসব দেশে ওই বছর যাওয়া শিক্ষার্থী সংখ্যা হচ্ছে-২৭৫০, ২৪৩৬, ১১৭৬, ১১৬৮, ৯৭৩, ৯০৭ জন। উল্লিখিত বছরে সবচেয়ে কম গেছেন ম্যাকাওতে, পাঁচজন। সর্বনিম্ন ১০০ শিক্ষার্থী গেছেন এমন দেশ ২৫টি। এগুলোর মধ্যে আছে-ফিনল্যান্ড, তুরস্ক, কাতার, থাইল্যান্ড, রাশিয়া, এস্তোনিয়া, নরওয়ে, পোল্যান্ড, হাঙ্গোরি, নিউজিল্যান্ড, চীন-হংকং, ডেনমার্ক, ইতালি, ওমান, ইউক্রেন, ফ্রান্স এবং পর্তুগাল।

আর ‘ওপেন ডোরস রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জ’ প্রতিবেদন ২০২১-২২ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে চলতি শিক্ষাবর্ষে সারা বিশ্ব থেকে এসেছে ৯ লাখ ৪৮ হাজার ৫১৯ জন। এর মধ্যে বাংলাদেশী ১০ হাজার ৫৯৭ জন, যেটি তালিকার ১৩ অবস্থানে আছে। অথচ এক দশক আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার ৩১৪ জন।
বিদেশে এভাবে শিক্ষার্থী চলে যাওয়ার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতাসহ বিকশিত হওয়ার অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবেই মূলত মেধাবী তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ উন্নত দেশে পাড়ি জমায়। এ ক্ষেত্রে তাদের আকৃষ্ট করে উন্নত দেশের গবেষণা, প্রযুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা, জীবনমান, আইনের শাসন আর স্থিতিশীলতা। যা আমাদের দেশে পুরোপুরি অনুপস্থিত ও কল্পনারও অতীত।

একটি ব্লগে দেখা যায়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর আগে একটি বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন জনৈক এক ছাত্রী। নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি বিবেচিত হননি। একজন ছাত্র রাজনৈতিক দলের বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা হওয়ায় অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী তারই সহপাঠী নিয়োগটি পেয়েছেন। এরপর তিনি ক্ষোভ ও অপমানে সুইডেনে বৃত্তি নিয়ে চলে যান লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে। তিনি বর্তমানে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সুইডিশ নাগরিকত্বও গ্রহণ করেছেন।

কানাডার সিনথেটিক অর্গানিক ক্যামিস্ট্রির একজন সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্টের মতে, বিদেশে মেধাবীদের এভাবে চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের অনেক ঘটনা আছে। তিনি মনে করেন, একজন মেধাবীর মূল্যায়িত হওয়ার পথে দেশে কম-বেশি প্রতিবন্ধকতা আছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে হলে তাকে হলুদ-বেগুনি বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত করতে হয় নিজেকে। কিন্তু একজন গবেষকের সেই সময় কোথায়। তিনি বলেন, তিনি জাপানে পাঁচজন অধ্যাপকের সঙ্গে কাজ করেছেন। কানাডায়ও কাজ করছেন। উন্নত বিশ্বে শিক্ষা ও গবেষণায় রাজনীতির কোনো রঙ নেই। সেখানে যোগ্যতা ও গবেষণার মানই মূখ্য। এমন পরিস্থিতিই মেধাবীকে উন্নত দেশই আকৃষ্ট করে।

সম্প্রতি চীন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি শেষে ফিরে এসেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক। তার ভাষায়, ‘আমরা বর্তমানে ‘নলেজ-ইকোনমি’র যুগে বসবাস করছি। এ কারণে অনেক দেশই মেধা লালনের নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত রুয়ান্ডা কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার দৃষ্টান্ত এর মধ্যে অন্যতম। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে প্রচুর বিদেশী চাকরি করেন। তাদের মাধ্যমে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে বেতন হিসাবে। কিন্তু তাদের স্থলে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী মেধাবীদের আনা সম্ভব হলে মেধাকেন্দ্রিক পরনির্ভরশীলতা কমানো যেত। পাশাপাশি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে কেউ আর বিদেশে ডিগ্রির জন্য না যায়।

সম্প্রতি এক নিবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক নিজের মেয়েকে অনার্স ডিগ্রি করতে বিদেশে পাঠানোর স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের ভালো বেতন এবং সম্মান প্রদান, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ, শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ, ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি বন্ধ-এসব বিষয় যদি নিশ্চিত করা যেত তাহলে মেধাবীদের যারা বিদেশে পড়তে যাচ্ছে, তাদের একটি বড় অংশ দেশেই পড়াশুনা করত। ফলে দেশের পরিবেশ এবং সংস্কৃতির মান উন্নত থাকত। দেশ তার সেরা মেধাবীদের সেবা পেত’। তার ওই নিবন্ধে ভর্তি সমস্যা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি করানোর ক্ষেত্রে বরাদ্দসংক্রান্ত অব্যবস্থাপনার চিত্র এবং মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে আনার পন্থা উল্লেখ করেছেন। যা খুবই যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত।

মূলত, দেশে মেধাবী অবমূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবেই দেশ থেক অবলীলায় মেধাপাচার হচ্ছে। যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের পর দেশে ফিরছেন না তারা সেটাকেই ভালো বিকল্প মনে করেন। তবে এটাও ঠিক যে, মেধাবীরা বিদেশে থাকলেও তারা দেশের জন্যই কাজ করেন। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ এর উদাহরণ। আসলে বর্তমান যুগে এটাকে ‘মেধা পাচার’ না বলে ‘মেধা সঞ্চালন’ হিসাবেই দেখতে চান অনেকেই। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি যেভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে, তাকে মেধা সঞ্চালন বলার কোন সুযোগ নেই। কারণ, যারা যাচ্ছেন তাদের উল্লেখযোগ্য শুধু চাকরি করা বা মেধা বিক্রির জন্য যাচ্ছেন না বরং দেশ থেকে সহায়-সম্পদ সবকিছুই নিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি তারা সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকত্বও গ্রহণ করছেন অবলীলায়।

মূলত, দেশ থেকে মেধা ও অর্থপাচার হয়ে যাওয়ার জন্য মেধাবী ও প্রতিভাবানদের অবমূল্যায়ন এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধার অভাবই মূল কারণ নয় বরং এর পেছনে আরও অনেক কারণ রয়েছে। দেশ থেকে বিদেশে পড়তে যাওয়ার একটি বড় অংশ হচ্ছে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তান। তারা দেশে অবৈধভাবে অনেক বিত্ত-বৈভব অর্জন করে তা নিরাপদ সংরক্ষণের জন্য বিদেশে পাচার করেন। একই সাথে তাদের সন্তানদেরও বিদেশে পাচার করা হয়। সুযোগ বুঝে তারা নিজেরাও আয়েশী ও বিলাস বহুল জীবনযাপনের জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। দেশে থাকতে তারা দেশ ও জাতির জন্য প্রাণপাত করলেও বিদেশে উড়াল দেয়ার পর তারা সবকিছু ভুলে বসেন। যা আমাদের মূল্যবোধের দেউলিয়াত্বের কথায় স্মরণ করিয়ে দেয়।

দেশ থেকে মেধাপাচারের সবচেয়ে কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের নেতিবাচক ও সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব এবং সুশাসনের অনুপস্থিতি। মূলত, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনের শাসনের অভাবেই মেধাবী ও প্রতিভাবানরা অবমূল্যানের শিকার হচ্ছেন। ফলে তারা দেশকে কোনভাবেই নিজেদের জন্য নিরাপদ মনে করতে পারছেন না। তাই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ থেকে নিজেদের মেধা ও প্রতিভার যথাযথ প্রয়োগের জন্য উন্নত বিশে^র দেশগুলোকে বেছে নেয়া হচ্ছে। আর দেশ থেকে এভাবেই মেধাপাচার হচ্ছে অবলীলায়। যা এখন রীতিমত উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এমতাবস্থায় দেশ থেকে মেধাপাচার বন্ধ করে মেধাবীদের দেশ ও জাতির স্বার্থে কাজে লাগাতে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার। একই সাথে দেশে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট ও সংঘাতের একটি যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য সমাধান হওয়া জরুরি। কোন অস্থির ও সংঘাতপূর্ণ পরিবেশ মেধার বিকাশ ও লালন কোন ভাবেই সম্ভব নয়। মেধাপাচারকে মেধা সঞ্চালন নাম দিয়েও ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে না। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই মঙ্গল।

https://dailysangram.com/post/513519