১২ জানুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ২:৫৩

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

জোড়াতালি দিয়ে চালু হচ্ছে এক শিফটের ক্লাস

শিক্ষক ও অবকাঠামোগত সংকট সত্ত্বেও জোড়াতালি দিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফট চালুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

চাপিয়ে দেওয়ায় এ সিদ্ধান্তের কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বেড়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার বাইরে চলে যাওয়ার শঙ্কা বেশি। পাশাপাশি মূলধারার বাইরেও শিক্ষার্থী চলে যেতে পারে। দেশে বর্তমানে ৬৫ হাজারের বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে।

এরমধ্যে ১০ হাজার ৯১৫ বিদ্যালয়ে দুই শিফট ক্লাস চালু আছে। অন্যদিকে নতুন জাতীয়করণ ২৬ হাজার বিদ্যালয়ে পদই আছে ৪ জন শিক্ষকের।

অর্থাৎ, এই দুই ধরনের বিদ্যালয়ে এক শিফটের পাঠদান করা হলে প্রথমত শিক্ষক পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত ক্লাসরুমও নেই।

ফলে অন্তত ৩৭ হাজার বিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষার্থী বিনিময় করতে হবে। ৪ জানুয়ারি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) সব বিদ্যালয়ে এক শিফট চালুর নির্দেশনা সংক্রান্ত চিঠি ৬৪ জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার (ডিপিইও) কাছে পাঠায়। এতে অবকাঠামোগত এবং শিক্ষক সংকটে ভোগা বিদ্যালয়গুলোকে পার্শ্ববর্তী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষার্থী বিনিময় করতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে এক কিলোমিটারের মধ্যে থাকা দুই বিদ্যালয়ের একটিতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় এবং অপরটিতে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নিতে বলা হয়েছে। জোড়াতালির এ উদ্যোগে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বেড়ে যাবে। অনেকেই দূরের প্রতিষ্ঠানে যেতে আগ্রহ নাও দেখাতে পারে। এতে ঝরে পড়ার হারও বেড়ে যেতে পারে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বুধবার যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষার্থীদের ‘কন্টাক্ট আওয়ার’ বা পাঠদানের সময় বাড়াতে এক শিফট চালুর এ উদ্যোগ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। যদিও তারা এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অংশীজনের মতামত নিয়েছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। চাপিয়ে দেওয়া এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে বাস্তবতা সামনে রাখা জরুরি ছিল। যদি ৩৭ হাজার বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বিনিময় করতে হয় এবং এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে লেখাপড়া করতে হয় তাহলে নিঃসন্দেহে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাবে।

এ ক্ষেত্রে যেসব অভিভাবক সন্তানকে লেখাপড়ার মধ্যে রাখতে চান, তাদের মধ্যে সচ্ছলরা সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়াম বা কেজি স্কুলে দেবেন।
আর অসচ্ছলরা মাদ্রাসায় পাঠাবেন। এর ফলে মূলধারার শিক্ষা দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) সরকার মূলধারাকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে অঙ্গীকার করেছে। তাই এই সিদ্ধান্ত সেই অঙ্গীকার লঙ্ঘন করবে। তাই বাস্তবায়নে সতর্ক হতে হবে।

এক শিফট চালু সংক্রান্ত ডিপিই’র জারিকৃত নির্দেশনায় বলা হয়, যেসব বিদ্যালয়ে বর্তমানে পর্যাপ্ত সংখ্যক ব্যবহারযোগ্য শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক আছ, সেসব বিদ্যালয়ে অবিলম্বে সিঙ্গেল শিফটে পাঠদান পরিচালনার ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ বা শিক্ষক নেই বা উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি আছে; এমন কাছাকাছি অবস্থিত (সর্বোচ্চ এক কিলোমিটার দূরত্বের) দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে পাঠদানের ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত কার্যক্রম চালু করতে হবে।
এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য দূরত্বের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী, শিক্ষকের সংখ্যা এবং বিদ্যালয়ের ব্যবহারযোগ্য শ্রেণিকক্ষের তথ্য বিশ্লেষণ করে পাশাপাশি দুটি বিদ্যালয়ে দুই ভাগ করে সিঙ্গেল শিফটে পাঠদান পরিচালনা করতে হবে।

এতে আরও বলা হয়-দুটি বিদ্যালয়ের মাঝে শ্রেণি বিভাজনের ক্ষেত্রে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত একটি বিদ্যালয়ে এবং অন্যটিতে তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে ডিপিই’র অধীন জনবলের মাধ্যমে সরেজমিন পরিদর্শন করে এক শিফট চালুর ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।

নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, সংশ্লিষ্ট জেলায় যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক ব্যবহারযোগ্য শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক আছে, সে সব বিদ্যালয়ে অবিলম্বে এক শিফটে পাঠদান পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে। ডিপিইওকে তার জেলায় যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ বা শিক্ষক নেই বা উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি আছে; এরূপ কাছাকাছি অবস্থিত দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রহণযোগ্য দূরত্বের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী, শিক্ষকের সংখ্যা এবং বিদ্যালয়ের ব্যবহারযোগ্য শ্রেণিকক্ষের তথ্য বিশ্লেষণ করে পাশাপাশি দুটি বিদ্যালয়ে দুই ভাগ করে এক শিফটে পাঠদান চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই করে বিস্তারিত তথ্যসহ (গাণিতিক ও বাস্তবতা) প্রতিবেদন পাঠাতে হবে।
এক্ষেত্রে, কাছাকাছি অবস্থিত কর্মরত দুটি বিদ্যালয়ের নাম, শিক্ষক সংখ্যা, শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা (শিক্ষক কক্ষ বাদে), ভৌগোলিক অবস্থান (প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা), দুটি বিদ্যালয়ের মধ্যবর্তী দূরত্বের তথ্য ছক আকারে পাঠাতে হবে। ২২ জানুয়ারির মধ্যে ই-মেইলে তথ্য পাঠাতে হবে।

ডিপিই সূত্র জানিয়েছে, সরকারি ৬৫ হাজার ৫৬৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে জাতীয়করণকৃত ২৬ হাজার বিদ্যালয়ে চারজন করে শিক্ষকের পদ আছে। অনেক পুরোনো বিদ্যালয়েও চার-পাঁচজন করে শিক্ষক আছেন। এছাড়া যে সাড়ে ১০ হাজারে দুই শিফট চালু আছে, সেখানে অবকাঠামোর পাশাপাশি শিক্ষক সংকটও আছে। তাই পদ না বাড়ালে এসব প্রতিষ্ঠানে এক শিফট করা সম্ভব নয়। কেননা, প্রাক-প্রাথমিক স্তর দুই বছর মেয়াদি করায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফটের ক্লাসের জন্য ৭টি কক্ষ দরকার। এছাড়া শিক্ষকের জন্য দরকার একটি কক্ষ। ৭টি কক্ষে একই সময়ে ৭ জন শিক্ষক দরকার। অবকাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে নতুন করে শিক্ষকের পদ বাড়াতে হবে। যদিও সরকার সর্বশেষ মধ্য ডিসেম্বরে সাড়ে ৩৭ হাজার নতুন শিক্ষক নিয়োগের ফল দিয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে তারা যোগদান করবেন।

কিন্তু ৩৭ হাজারের মধ্যে ২৬ হাজারই শিক্ষক প্রাক-প্রাথমিকের জন্য। সেই হিসাবে মাত্র ১১ হাজার সাধারণ শাখার শিক্ষক। অন্যদিকে প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষকরা অবসরে যাচ্ছেন। বছরে এ সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি। এ অবস্থায় শিক্ষক সংকটও এক শিফট চালুর ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, বিদ্যালয়ে এক শিফট চালুর উদ্যোগটি এখন পর্যন্ত সর্বজনীন করা হয়নি। যেখানে এক শিফট আছে তারা সেটি চালিয়ে যাবে। আর যেখানে দুই শিফট আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং ব্র্যাকের সহায়তায় সেগুলোর একটি ম্যাপিং করা হয়েছে। এখন তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

পাশাপাশি কিছু বিদ্যালয় নেওয়া হয়েছে যেখানে শিক্ষার্থী বিনিময়প্রথার পাইলটিং (পরীক্ষামূলক প্রয়োগ) করা হবে। সুতরাং, হুট করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। পাইলটিংয়ের ফল বিবেচনায় সর্বজনীন করা হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/633983