১১ জানুয়ারি ২০২৩, বুধবার, ১২:০৯

ভরা মৌসুমে আখ পাচ্ছে না চিনিকল

দেশে বর্তমানে ১৫টি চিনিকল আছে। এর মধ্যে চালু আছে ৯টি। তবে আখের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় মৌসুমের শুরুতেই একটি চিনিকল বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষকরা বলছেন, চিনিকলে আখ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত দাম পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বেশি দামে গুড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন, আখ চাষি ও চিনিকলের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে চিনির দাম বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় আখের দাম বাড়েনি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে এখন দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে চিনি। তবে আখের দাম বেড়েছে সামান্যই। ফলে কৃষকরা চিনিকলে আখ না দিয়ে গুড় প্রস্তুত করে বিক্রিতে আগ্রহী হচ্ছেন। এতে আখ মৌসুমের শুরুতে চিনি উৎপাদনে ধাক্কা লেগেছে। চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা আছে।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের তথ্যে জানা গেছে, ২০১৭ সালে চিনির দাম ছিল প্রতি টন ৬০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতি কেজির দাম ৬০ টাকা। এর পর থেকে চিনির দামের হ্রাস-বৃদ্ধির পর গত বছরের নভেম্বরে ৮৫ টাকা কেজি হয়। ডিসেম্বরে দাম নির্ধারণ করা হয় ১০০ টাকা কেজি। আর ২০১৭ সালের পর পাঁচ বছরে আখের দাম মিলগেটে কুইন্টালপ্রতি (১০০ কেজি) দাম ৩১২.৫০ থেকে বেড়ে ৪৫০ টাকা হয়। অর্থাৎ এক মণ আখের দাম ১৮০ টাকা। আর মিলগেটের বাইরে ৩০৫.৯০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪৪০ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ এক মণের দাম ১৭৬ টাকা।

আখ চাষের খরচ : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে ২০২১-২২ অর্থবছরে এক একর জমিতে আখ চাষ করতে খরচ হয় ৬৬ হাজার ৯০৩ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় খরচ হয় প্রায় ২২ হাজার ৩০১ টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এক বিঘা জমিতে আখ পাওয়া যায় প্রায় ১৫৪ মণ। সেই হিসাবে ১৮০ টাকা দরে এক মণ আখ চিনিকলে বিক্রি করলে পাওয়া যায় ২৭ হাজার ৭২০ টাকা। অন্যদিকে গুড় উৎপাদনকারীদের কাছে আখ বিক্রি করলে কৃষক পাচ্ছেন ৩৮ হাজার ৫০০ টাকা। এক বিঘা জমির আখ চিনিকলে বিক্রি করলে লাভ হয় পাঁচ হাজার ৪১৯ টাকা। অন্যদিকে স্থানীয় গুড় উৎপাদনকারীদের কাছে একই আখ বিক্রি করলে লাভ পাওয়া যায় ১৬ হাজার ১৯৯ টাকা।
আখ চাষি ও কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, আখের দাম কম পাওয়ার কারণে কৃষকরা সরকারি চিনিকলগুলোতে আখ দিচ্ছেন না। ফলে ভরা মৌসুমেও পুরোদমে চিনিকল চালানো যাচ্ছে না। এতে চিনি উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা তা পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে বেসরকারিভাবে আমদানি করা কম্পানিগুলো যেমন খুশি, তেমনি চিনির মূল্য বৃদ্ধি করলে সরকারের কিছুই করার থাকবে না।

চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, দেশে সরকারি ১৫টি চিনিকল রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে চলতি মৌসুমে ৯টি চালু করা হয়। তবে চিনির অভাবে মৌসুমের শুরুতেই একটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, রাজশাহী, নাটোর, নর্থবেঙ্গল, কেরু অ্যান্ড কোং, মোবারকগঞ্জ, ফরিদপুর ও জিলবাংলায় চিনি উৎপাদন হচ্ছে।

নাটোর চিনিকল বন্ধ : ৩৭ দিন আখ মাড়াই করার পর ৭ জানুয়ারি নাটোর চিনিকল বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। চিনিকলের তুলনায় গুড় ব্যবসায়ীদের বেশি দামে আখ ক্রয় ও অবৈধ পাওয়ার ক্রাশার মেশিনে মাড়াইয়ের কারণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয় বলে জানা গেছে। চলতি মৌসুমে ৫৪ কর্মদিবসে ৮০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ৩৭ দিনে ৫০ হাজার ৭৩৮ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করতে পেরেছে চিনিকলটি।

নাটোর প্রতিনিধি জানান, চিনিকলের আটটি জোন এলাকায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি জোনের ক্ষেতেই আখ আছে। সব মিলিয়ে অন্তত ২০ হাজার টন আখ ক্ষেতে আছে। কিন্তু সুগার মিলের চেয়ে বেশি দাম পাওয়ায় চাষিরা গুড় ব্যবসায়ীদের কাছে আখ বিক্রি করছেন, যা সরাসরি পাওয়ার ক্রাশারে নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে গুড় উৎপাদন করা হচ্ছে।

নাটোর সদরের তেবাড়িয়া এলাকার আখ চাষি মো. মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গুড় ব্যবসায়ীদের কাছে আখ বিক্রি করলে দাম বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু মিলে দিলে লোকসান হয়। এ জন্য আমরা চিনিকলে আখ না দিয়ে গুড় ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করছি। এ ছাড়া চিনিকলে আখ সরবরাহ করলে টাকা তুলতে অনেক সময় লাগে। যদি মোবাইল ব্যাংকিং মাধ্যমে টাকা দিত, তাহলে টাকা পাওয়া সহজ হতো।’
নাটোর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, নাটোর চিনিকল থেকে চাষিদের সার, বীজ, টাকাসহ ঋণ দেওয়া হয়। এরপর চুক্তি অনুযায়ী মিলে আখ সরবরাহের কথা থাকলেও চাষিরা সরবরাহ করছেন না। ফলে আখসংকটে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে চিনিকল।
আখ চাষে নিরুৎসাহ চাষিরা : ফরিদপুরের মধুখালীতের চিনিকল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই লোকসান গুনছে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানেও পর্যাপ্ত পরিমাণ আখ না পাওয়ায় এই অবস্থা। মূল্য সময়মতো না পাওয়া এভং আখ দীর্ঘমেয়াদি ফসল হওয়ায় চাষে আগ্রহ হারিয়ে অন্য ফসল আবাদে ঝুঁকছেন চাষিরা।
মিলগেট এলাকার আখ চাষি মো. আলী শেখ বলেন, ‘চিনিকলে আখ সরবরাহে আমাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি হতে হয়। এ ছাড়া যে জমিতে বছরে তিনবার ফসল আবাদ করা যায়, সেখানে আখ চাষ করলে মাত্র একবার মূল্য পাওয়া যায়, যা অন্য ফসলের তুলনা অনেক কম।’

 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/01/11/1224140