১১ জানুয়ারি ২০২৩, বুধবার, ১২:০৬

ব্যয় ২৫০০ কোটি টাকা বাড়তে পারে

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। সময় বাড়ার সঙ্গে প্রকল্পের মোট খরচের প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ ব্যয় বাড়ানোরও প্রস্তাব উঠছে।

সম্প্রতি প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ানোর প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে সেতু বিভাগ। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী সপ্তাহে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব তুলতে যাচ্ছে সেতু মন্ত্রণালয়। পাথরসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়া, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নতুন যন্ত্রপাতি কেনাসহ আরো কিছু কারণে প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে।

পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয় গত বছরের ২৫ জুন। পরদিন থেকে যান চলাচল শুরু হয়। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সেতুর কাজ শেষ ৯৯.৬০ শতাংশ। নদীশাসনের কাজ শেষ ৯৫.৭৫ শতাংশ। চলতি বছরের ৩০ জুন শেষ হতে যাচ্ছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মেয়াদ। সব ধরনের কাজ মিলিয়ে গত মাস পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক কাজ এগিয়েছে ৯৫.৫০ শতাংশ। এখন এই প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব উঠতে যাচ্ছে।

সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, ডিসেম্বর থেকেই প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছিল। নতুন বছরের শুরুতে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে এটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। পদ্মা সেতুর সর্বশেষ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবে এই ব্যয়ের ওপর প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ ব্যয় বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়তে পারে দুই হাজার ৫৬৬ কোটি ৪৩ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬০ টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে এটা ঠিক। সাড়ে ৮ শতাংশ নয়, একটু কম। তবে ৮ শতাংশের বেশি। আমরা প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন মন্ত্রণালয় থেকে আগামী সপ্তাহে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হতে পারে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, পাথরসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়া ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নতুন যন্ত্রপাতি কেনাসহ আরো কিছু কারণে প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বড় প্রকল্পের কাজের ধরন অনুযায়ী, নির্মাণকাজ শেষে প্রকল্প চালু হলে এক বছর ‘ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড’ ধরা হয়ে থাকে। এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কোনো কাজে ত্রুটি দেখা দিলে দায় পুরোপুরি ঠিকাদারের ওপর বর্তায়। ঠিকাদার সেটা ঠিক করে দেয়। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত। আর গত বছরের ২৫ জুন সেতু উদ্বোধনের পর থেকে ‘ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড’ শুরু হয়েছে। ফলে এ জন্য আলাদা করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হয়নি। প্রকল্পের অধীনে নদীশাসনের কাজ এখনো চলছে। চলতি মেয়াদের মধ্যেই নদীশাসনের কাজ শেষ করা যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদীশাসন) মো. শারফুল ইসলাম সরকার কালের কণ্ঠকে, ‘জাজিরা প্রান্তে নদীশাসনের কাজ প্রায় শেষ। এখন শেষ মুহূর্তের কিছু কাজ চলছে। আর মাওয়া প্রান্তে নদীশাসনের কাজ পুরোদমে চলছে। আশা করি, নির্ধারিত সময় ৩০ জুনের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।’
সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, নদীশাসনের কাজের জন্য ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড এক বছর দিতেই হবে। তাই প্রকল্পের মেয়াদ এ জন্য হলেও বাড়াতে হতো। এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের অন্য কাজগুলোও শেষ করা হবে।

প্রকল্পের নথির তথ্য বলছে, প্রকল্পে ৬.১৫ কিলোমিটার সেতু নির্মাণে কাজ করেছে চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কম্পানি লিমিটেড। বর্তমানে মূল সেতু ‘ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডে’ আছে। ঠিকাদারকে পরিশোধ করা হয়েছে ১২ হাজার ২২১ কোটি টাকা, যা মোট খরচের ৯৭.৮২ শতাংশ। আর সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৯৯.৬০ শতাংশ।

প্রকল্পে নদীশাসনের কাজ করছে চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। এতে খরচ হচ্ছে প্রায় আট হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। এখানে এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে আট হাজার ১২৬ কোটি টাকা। নদীশাসনের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯৫.৭৫ শতাংশ।

প্রকল্পের অধীনে অন্যান্য বড় কাজের মধ্যে জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তের সংযোগ সড়কের কাজ শতভাগ শেষ। প্রকৌশলীদের সাপোর্ট ও সেফটি এবং সার্ভিস এরিয়ার কাজও হয়ে গেছে। জমি অধিগ্রহণের কাজ হয়েছে ৯৯.৫০ শতাংশ। পুনর্বাসনের জন্য পদ্মা নদীর দুই প্রান্তে আধুনিক নাগরিক সুবিধা সংবলিত সাতটি পুনর্বাসন সাইট নির্মাণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া পদ্মা সেতুর উভয় প্রান্তে পুনর্বাসন এলাকা, সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়াগুলোতে বনায়নের জন্য চার লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা ছিল। এ পর্যন্ত মোট এক লাখ ৭৩ হাজার ২৯৪টি গাছ লাগানো হয়েছে। নদীশাসন ও মূল সেতুর কাজ পুরো শেষ হলে উন্মুক্ত জায়গায় বাকি গাছ লাগানো হবে। গাছ লাগাতে খরচ হচ্ছে আট কোটি ৯৭ লাখ ৯৬ হাজার ১৭৮ টাকা।

পদ্মা সেতু জাদুঘর স্থাপনে ব্যয় হচ্ছে ছয় কোটি ২১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৯৫ টাকা। আগামী ৩০ জুন জাদুঘরের কাজ শেষ হওয়ার কথা। বাস্তবায়ন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। তথ্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। খরচ হচ্ছে ছয় কোটি ৩১ লাখ ৩৫ হাজার ৭৩৫ টাকা। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির আওতায় এরই মধ্যে ‘পদ্মা সেতু বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য’ ঘোষণা সম্পন্ন হয়েছে এবং গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। পদ্মা সেতু বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণার কার্যক্রম চলমান আছে। পদ্মা সেতু বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একটি ‘ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ পরামর্শকদলের মাধ্যমে দাখিল করা হয়েছে। এতে খরচ হচ্ছে আট কোটি ৩০ লাখ ৭২ হাজার ৯৫০ টাকা। ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট কনসালটেন্সিতে খরচ হচ্ছে ১৬৮ কোটি ৯৭ লাখ ৬৯ হাজার ৮৬০ টাকা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে নতুন করে ব্যয় বাড়ার কারণ জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধান কারণ ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। এর সঙ্গে আরো কিছু কারণ আছে। নথি না দেখে বিস্তারিত বলা যাবে না।’

এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোন কোন খাতে খরচ কত বাড়ছে এখন সেটা দেখা দরকার। যদি সেতুতে খরচ বাড়ে তাহলে আমি আহত হব। অন্যান্য প্রকল্পের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, নদীশাসনের কাজ কাগজে যতটা হয়েছে, বাস্তবে তা হয়নি। ধারণা করছি, নদীশাসনে খরচ বেশি বাড়তে পারে। যত যাই হোক, প্রকল্পের এই অবস্থায় এসে আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ বাড়া যৌক্তিক হচ্ছে না।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/11/1224103