৯ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ১২:৫৪

১৭১ কোটি টাকার কাজে সুফল নেই, আবার ৬৭৭ কোটির প্রকল্প

রাজশাহী বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) অধীন খাল খনন প্রকল্পটি কৃষকের কাজে লাগেনি। খালটি খননের পর থেকে দুই পার ভেঙে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে খালে পানি থাকে না। রাজশাহী কাটাখালি সুগার মিলের পাশে খালটির বর্তমান অবস্থা। ছবি: কালের কণ্ঠ
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে রাজশাহীসহ উত্তরের ৯ জেলায় ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৩০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। এরও আগে আরো ৪১ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তারা। কৃষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, এসব প্রকল্পে খুব একটা সুফল নেই। এ অবস্থায় বিএমডিএ তিনটি গুচ্ছে আরো ৬৭৭ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাল খনন করে মাটি খালপারেই স্তূপ করে রাখা হয়। বৃষ্টি শুরু হলে সেই মাটিতেই খাল আবার ভরাট হয়ে যায়। এভাবেই আগের প্রকল্প দুটি বছর না ঘুরতেই মুখ থুবড়ে পড়ে। খালে শীতকালে কিছুটা পানি থাকলেও চৈত্র-বৈশাখ খরা মৌসুমে একেবারে শুকিয়ে যায়। জমিতে সেচ দেওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪-১৮ মেয়াদে তিন হাজার ৫৪০ হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় আনার লক্ষ্যে ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্প শেষ হয় ২০১৯ সালের দিকে। আর ২০১৪ সালের আগে রাজশাহী অঞ্চলে ৪১ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিএমডিএ।

বিএমডিএ সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ মেয়াদে খাল খননের মাধ্যমে ‘ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে নাটোর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ’ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটির কাজ চলছে। সম্প্রতি এ প্রকল্পের আওতায় ৭৫টি গ্রুপে টেন্ডার হয়েছে। প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয় হবে এই ৭৫ গ্রুপের কাজে। গত বছর থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পে ১৫৫ কিলোমিটার খালের মধ্যে খনন করা হয়েছে ৫৫ কিলোমিটার। সাত হাজার ২৫৭ হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে কৃষিজমি উপযোগীকরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৪৭ হেক্টর। এই প্রকল্পের অগ্রগতি ৩৩ শতাংশ।

ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২৪ মেয়াদে ২৫০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প চলছে। খাল খননের মাধ্যমে ১০ হাজার ২৫০ হেক্টর কৃষিজমি সেচ সুবিধার আওতায় আনার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩৫০ হেক্টর জমির। প্রকল্পটির অগ্রগতি প্রায় ২১ শতাংশ। এখনো টেন্ডার চলছে।

এ ছাড়া খাল খননের মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানি উন্নয়নের মাধ্যমে বৃহত্তর দিনাজপুর ও জয়পুরহাট জেলায় সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পটিও চলমান। ২০২০-২৫ মেয়াদের প্রকল্পটির অগ্রগতি ১২ শতাংশ। এখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫১ কোটি টাকা। এখানেও সেচ সুবিধার আওতায় আনার লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১০ হাজার ২০৫ হেক্টর জমি। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩০৬ হেক্টর জমির।

উত্তরের ৯ জেলায় বাস্তবায়িত ২০১৪-১৮ মেয়াদের প্রকল্পের আওতায় রাজশাহীর পবা জোহাখালী খালটি খনন করা হয়। ৩.১৪৭ কিলোমিটার খালটি খননে ব্যয় হয় প্রায় ১০ কোটি টাকা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খালটি এখন মৃতপ্রায়। খালপারের কৃষক আবুল কালেম বলেন, ‘বিএমডিএর খাল খনন প্রকল্পগুলো ভূতুড়ে। খাল খনন করার পর মাটি ফেলা হয় খালপারেই। আবার যে পরিমাণ গভীর করার কথা বলা হয়, সেটিও করা হয় না। ফলে বছর না যেতেই ভরাট হয়ে যায় খালগুলো। এতে খরা মৌসুমে কোনো কাজে আসে না খননকৃত খালগুলো। শুধু টাকা অপচয় হচ্ছে সরকারের।’ তিনি আরো বলেন, এ খালটি চার-পাঁচ বছর আগে খনন করা হয়েছে। এখন সামান্য পানি আছে। শীত পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ পানিও থাকবে না। খাল খননের আগেও বর্ষার পর কিছুদিন পানি থাকত। এরপর খরা মৌসুমে পানি থাকত না। এখনো অবস্থা আগের মতোই। তাহলে এই খাল খনন করে কী লাভ হলো? চৈত্র-বৈশাখে ধানসহ অন্যান্য ফসল চাষ করতে গভীর নলকূপ থেকেই পানি সেচ দিতে হবে। খাল কোনোই কাজে আসে না।’

দুই বছর আগে রাজশাহীর কাটাখালী খালটি খনন করা হয়েছিল প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে। সেই খালে গিয়ে দেখা গেছে, কোথাও হাঁটুসমান পানিও নেই। যে মাটি কেটে খালপারে ফেলা হয়েছিল, সেগুলো আবার খালে নেমে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে কোথাও সামান্য পানি, তো কোথাও শুকনা। আবার কোথাও কচুরিপানায় ভরে গেছে। পবার হরিয়ান বিলের কৃষকদের জন্য এ খাল খনন করলেও তা কাজে আসছে না। বাধ্য হয়ে কৃষকরা শ্যালো মেশিন দিয়ে জমিতে সেচ দিচ্ছেন।

রাজশাহীর বাঘায় একই প্রকল্পের আওতায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছিল খাল খননে। সেসব খালেও খরার সময় পানি থাকে না বলে জানায় আশপাশের বাসিন্দারা। এ ছাড়া ভূ-উপরিস্থ পানি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রাজশাহীর চারঘাট থেকে পুঠিয়া পর্যন্ত বড়াল খাল (নদী) খননের জন্য ব্যয় করা হয়েছিল আট কোটি টাকা। এ খালটিতেও খরার সময় পানি থাকে না বলে জানান খালপারের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম।
চারঘাটের বড়াল খালটি প্রস্থে ১৫ মিটার ও গভীরতায় পাঁচ-ছয় মিটার করার কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি। আর খনন করা মাটিগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নের পরপরই খালে চলে যায়।

চারঘাটের নন্দনপুর এলাকার কৃষক শরিফুল ইলাম বলেন, ‘বছর না যেতেই খালটি আবার ভরাট হয়ে যায়। জলে গেছে খননের সব টাকা।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান কালের কণ্ঠকে বলেন, খাল খনন কৃষকদের কোনোই কাজে আসছে না। যে টাকা সরকারের অপচয় করছে বিএমডিএ, সেই টাকা কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করলে এর চেয়ে বেশি উপকৃত হবেন তাঁরা। কিন্তু খাল খনন করে ছয় মাসেই সেই খাল আবার আগের মতো অবস্থায় পরিণত হচ্ছে। ফলে সরকারের টাকা পানিতে যাচ্ছে।’

নতুন প্রকল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে নাটোরের খাল খনন প্রকল্পের পরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এবারকার প্রকল্পটি খবুই গুরুত্ব দিয়ে করব। কোনো অনিয়ম হবে না। এ প্রকল্পের আওতায় খাল খনন হলে কৃষকরা উপকৃত হবেন। টেন্ডারেও কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই। ওপেন পদ্ধতিতে টেন্ডার হচ্ছে। যারা যোগ্য, তারা কাজ পাবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/09/1222302