৯ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ১২:৫২

দুরবস্থায় বাসের ই-টিকেটিং ব্যবস্থা

রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বাড্ডার দিকে যাচ্ছিল বাস ‘অছিম’। বাসের দরজায় দাঁড়ানো ভাড়া আদায়কারী ইচ্ছামতো টিকিট কাটার মেশিন থেকে টিকিট নিচ্ছেন আর ছিঁড়ে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলছেন। এভাবে টানা ১৮টি টিকিট ছিঁড়ে ফেলতে দেখা যায়। যমুনা ফিউচার পার্ক পার হলেই মেশিনটি পকেটে ঢুকিয়ে নেন। এরপর শুরু করেন যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়। এই চিত্র গত ২ জানুয়ারির।
আজিমপুর থেকে মিরপুর ১০ নম্বর যাচ্ছিল ‘মিরপুর সুপার লিংক’ নামের একটি বাস। কলাবাগান থেকে আগারগাঁও যেতে ওই বাসে ওঠেন রুহুল আমীন হাওলাদার। আসাদ গেট যেতেই ভাড়া আদায়কারী এলেন ভাড়া নিতে। ভাড়া চাইলেন ২৫ টাকা। বাসে ভাড়ার কোনো তালিকা নেই। তালিকা না থাকায় ২৫ টাকা দিতে চাননি রুহুল। এ নিয়ে শুরু হয় কথা-কাটাকাটি। এক পর্যায়ে গলায় ঝোলানো মেশিন থেকে টিকিট বের করে রুহুলের হাতে দেওয়া হলো। তাতে ভাড়া লেখা ২৩ টাকা। গন্তব্য আজিমপুর থেকে আগারগাঁও। রুহুলের কথা, তিনি উঠেছেন কলাবাগান থেকে। এরপর এলো নতুন টিকিট; তাতে ভাড়া লেখা ১৮ টাকা। কিন্তু কোনো টিকিটেই দূরত্ব কত কিলোমিটার, তার উল্লেখ নেই। এই চিত্র গত ২৭ ডিসেম্বরের।

রাজধানীতে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা এমনই দুরবস্থায় রয়েছে। কাগজে-কলমে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। গত ২৭ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি রাজধানীর বিভিন্ন বাসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গলায় মেশিন ঝোলানো থাকলেও টিকিট ছাড়াই যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ভাড়া আদায়ে মানা হচ্ছে না বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নির্ধারিত তালিকা। ওয়েবিল প্রথা বাতিল করা হলেও তা চলছে। ওয়েবিলের কারণেই যাত্রী ভাড়া বাড়ছে।

জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ই-টিকেটিং ব্যবস্থায় কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে। আমরা সেগুলো পর্যবেক্ষণ করছি। যাত্রীরা সঠিকভাবে টিকিট পাচ্ছে কি না তা মনিটর করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাত্রীদের কাছ থেকে যেন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা না যায় সে জন্যই ই-টিকিট চালু করা হয়েছে।’
টিকিটে দূরত্বের বিষয়টি কেন উল্লেখ নেই জানতে চাইলে মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রতি কিলোমিটার ভাড়ায় পয়সা (দুই টাকা ৪৫ পয়সা) যুক্ত রয়েছে। মোট দূরত্ব দিয়ে হিসাব করলে ভাড়ায় টাকার সঙ্গে পয়সা চলে আসবে। ওই ঝামেলা এড়াতেই কিলোমিটার উল্লেখ করা হয়নি। তবে বিআরটিএর নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ীই ডিভাইসে ভাড়া যুক্ত করা হয়েছে।

২০১২-১৩ সালে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) বাসে প্রথম ই-টিকেটিং ব্যবস্থার প্রচলন করে। তখন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাসে যাত্রীদের কাছ থেকে র?্যাপিড পাসের মাধ্যমে ই-টিকিটে ভাড়া আদায় শুরু হয়। যদিও দীর্ঘ মেয়াদে এই ব্যবস্থা সফলতার মুখ দেখেনি। নতুন করে গত সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা সড়ক পরিবহন বাস মালিক সমিতি ই-টিকিটং প্রথার প্রচলন করেছে।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সূত্র বলছে, বর্তমানে মিরপুরকেন্দ্রিক ৩০ প্রতিষ্ঠানের দেড় হাজার বাসে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আগামীকাল থেকে উত্তরা ও আজিমপুরকেন্দ্রিক আরো ১০ প্রতিষ্ঠানের এক হাজার বাসকে ই-টিকেটিং ব্যবস্থার আওতায় আনা হচ্ছে।
রাজধানীর গণপরিবহনে ওয়েবিল ও বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধ করতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর আটটি কম্পানির বাসে পরীক্ষামূলকভাবে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। বাস মালিক সমিতির কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ঢাকা শহরের ৬০টি প্রতিষ্ঠানের সব বাস ই-টিকিটের আওতায় আনা হবে। ঢাকা ও আশপাশের জেলায় প্রায় পাঁচ হাজার ৬৫০টি বাস চলাচল করে। আর শুধু ঢাকা মহানগরে চলে তিন হাজার ১৪টি বাস। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঢাকাসহ আশপাশের ৯৭টি প্রতিষ্ঠানের বাস ই-টিকিটের আওতায় আনার চিন্তা রয়েছে।
ই-টিকেটিংয়ের মেশিন বানিয়েছে যাত্রী সার্ভিসেস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এখন পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি মেশিন বাস মালিক সমিতিতে হস্তান্তর করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আরো চার হাজার মেশিন পাইপলাইনে রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসফাক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মালিক সমিতি যেভাবে মেশিন চেয়েছে আমরা সেভাবেই বানিয়ে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত টিকিটে যাত্রার দূরত্বের হিসাব তারা উল্লেখ করতে বলেনি।’

বাস মালিক সমিতির এক নেতা বলছেন, ‘অনেক চেষ্টার পরও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় আমরা থামাতে পারিনি। যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের টাকা মালিকরা পান না। সেটা চালক-হেলপারের পকেটে ঢুকে যায়। এ জন্য ই-টিকিট ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সংগঠন কাজ করছে। ই-টিকেটিং ব্যবস্থা মজবুত হলে যেমন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ হবে, তেমনি চুরিও বন্ধ হবে। যেখানে-সেখানে বাস দাঁড়াবে না। একই সঙ্গে বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতাও বন্ধ হবে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজধানীর বাসগুলো এখন যেভাবে চলছে এই পরিস্থিতিতে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা টিকবে না। চালকরা আয় করবেন আর মালিক বাস ইজারা (লিজ) দিয়ে সব টাকা নিয়ে নেবেন, এমনটা শ্রমিকরা হতে দেবেন না। এ জন্য পরিবহন শ্রমিকদের আগে মাসিক বেতনের আওতায় আনতে হবে। বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি ফর্মুলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে সড়ক ও বাস ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরবে। তখনই ই-টিকেটিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/09/1222283