৯ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ১২:১৯

সবুজ পাহাড়ে আধিপত্যের লড়াই ঘটে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ

গত বছর (২০২২) সালে সবুজ পাহাড় ছিল অনেকটা উত্তপ্ত। কিছু দিন পরপরই পাহাড়ে বিভিন্ন গ্রুপ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সন্ত্রাসী দলগুলোর মধ্যে আধিপত্যের লড়াইয়ে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় গত বছরে সন্ত্রাসীদের হাতে কমপক্ষে ২১ জন প্রাণ হারান এক বছরে।

এ ধরনের কয়েকটি হত্যাকান্ডের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে পার্বত্য অঞ্চলে। পাহাড়ে প্রায় প্রতি মাসে একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এতে চরম উৎকণ্ঠায় দিন কেটেছে পাহাড়ের মানুষের। হিসাব মতে, গত এক বছরে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান তিন পার্বত্য জেলায় সন্ত্রাসী হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলো ঘটে। ফেব্রুয়ারিতেই নিহত হন ১০ জন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতারাও হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। আত্মগোপনে থেকে চালায় শান্তিচুক্তি বিরোধী তৎপরতা। গহীন পাহাড়ে আধুনিক মারনাস্ত্র নিয়ে আঞ্চলিক নেতারা জোট বাঁধেন নিজের দেশের বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে শঙ্কিত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় মানুষ। জেএসএসের বাইরেও এসময় পাহাড়ে তৎপরতা বাড়ে ইউপিডিএফসহ কয়েকটি সশস্ত্র দলের। তাদের উপস্থিতি ও চলাফেরায় ফের সন্ত্রস্ত হয় বাংলাদেশের পার্বত্য জনপদ। একেবারে দুর্গম পাহাড়েও তাই লেগেছে চাপা উত্তেজনার আঁচ। তিন দেশের সীমান্তের সবচেয়ে কাছের পাড়া ধুপানীছড়া। ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে এই জায়গাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সশস্ত্র গোষ্ঠীর আনাগোনা বেশি বেড়েছে এর উত্তরের শিপ্রু পাড়া থেকে দক্ষিণে জারুছড়ি পাড়া পর্যন্ত। নতুন করে এলাকাগুলো দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে তারা। গত বছর বান্দারবানে এক পাড়াপ্রধান ও তার চার ছেলেকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার একদিন পরই জেএসএসের এক সাবেক কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার কয়েকদিন আগে বান্দরবানের রুমা জোনের একটি টহল দলের সঙ্গে জেএসএস মূল দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলি বিনিময়ের ঘটনায় সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার নিহত হন। এসময় তিনজন সশস্ত্র সন্ত্রাসীও নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হয় একজন সেনা সদস্য। কিছু দিন পর পরই পাহাড়ে হত্যাকান্ডের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে পাবত্য অঞ্চলে। এতে চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন পাহাড়ের মানুষ।

জানা গেছে, নানা প্রতিকূলতায় ভরা বিশাল এ জনপদকে নিশ্ছিদ্র রাখা সহজ কাজ নয়। জনসংহতি সমিতি (সন্তু), ইউপিডিএফ-প্রসিতসহ কয়েকটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র অবস্থানের খবর পাওয়া যায় তিন পার্বত্য জেলার আরও অনেক গ্রামে। শান্তিচুক্তির পরে অস্ত্র যেভাবে জমা হওয়ার কথা ছিল, অস্ত্রগুলো সেভাবে জমা হয়নি। সন্ত্রাসীদের কাছে এখনও সেসব অস্ত্র রয়ে গিয়েছে। নতুন অস্থিরতার শঙ্কায় বথি পাড়া, রুমার যে গ্রামে সবশেষ রক্ত ঝড়েছে। এখানকার মানুষের ভয়ের কারণ হচ্ছে চুক্তি ভেঙে আবারও আগের পথে যাচ্ছে হয়তো আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো। বথিপাড়ার এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেছেন, আমরা তো শান্তিতেই থাকতে চাই। পরিবার আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ভাল থাকতে চাই।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানে ‘জেএসএসের সাবেক কর্মী’কে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর একদিন আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানে ৪ ছেলেসহ পাড়াপ্রধানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন, আবুপাড়ার কারবারি (পাড়াপ্রধান) লকরুই ম্রো (৭০) এবং তার ৪ ছেলে রুনতুই ম্রো (৩৫), রেংঙি ম্রো (৩০), মেনওয়াই ম্রো (২৫) ও রিংরাও ম্রো (২০)। এছাড়া রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম বড়থলি ইউনিয়নে দুর্বৃত্তের গুলিতে বাবা-ছেলেসহ তিন জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

এদিকে বছরের শেষের দিকে পাহাড়ে জঙ্গী তৎপরতার খবর দেয় র‌্যাব। বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে জঙ্গী প্রশিক্ষণের গোপন আস্তানাগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মহাপরিচালক খুরশীদ হোসেন। গত ২৬ অক্টোবর খুরশীদ হোসেন বলেন, আগস্ট মাসে কুমিল্লা থেকে প্রায় ৫৫ জন তরুণ নিখোঁজ হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। তারই সূত্র ধরে র‌্যাবের গোয়েন্দা দল তদন্ত করে ৩৫ জনের মতো তরুণ বাড়ি থেকে নিখোঁজের বিষয়ে নিশ্চিত হয়। তদন্তে জানা যায়, ওই তরুণেরা হিজরতের নামে বাসা থেকে বের হয়ে চলে গেছে। সমতল ভূমিতে আগের মতো জঙ্গী তৎপরতা করার সুযোগ না পেয়ে, তারা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় আস্তানা গাড়ে। তিনি বলেন, পাহাড়ি বিছিন্নতাবাদী বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে, কোনো একটি সংগঠনের ছত্রছায়ায় তারা বান্দরবানে আস্তানা গেড়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে-এমন তথ্যের ভিত্তিতে সরকারের ওপরের মহলে বিষয়টি জানালে তারা অপারেশন পরিচালনার জন্য নির্দেশ দেন। এরপর সেনা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ড্রোনের মাধ্যমে তাদের (জঙ্গীদের) অবস্থান শনাক্ত করে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে কয়েকজনকে গ্রেফতার ও ২১টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এটি জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর একটি যৌথ অভিযান ছিল উল্লেখ করেন র‌্যাব ডিজি বলেন, পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি বলেন, যেসব জায়গায় তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলো, সেসব জায়গা শনাক্ত করে গুঁড়িয়ে দিয়ে দখলে নেওয়া হয়েছে। তারা এখন দুই ভাগ হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে আমরা একজনের মরদেহ পেয়েছি এবং একজন আত্মসমর্পণ করেছে।

 

https://dailysangram.com/post/513188