৮ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ৯:৪৬

হাসপাতালে ৫৪ দিনে সাড়ে তিন লাখ রোগী

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের গতকাল রাত ৮টার চিত্র। ছবি : কালের কণ্ঠ
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড। নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে দুই দিন ধরে মেঝেতে আছেন সদর উপজেলার হাতিকাটা গ্রামের মমতাজ আরা। গতকাল শনিবার হাসপাতালে দেখা গেল মমতাজের মতো অনেক মা এসেছেন শিশুদের চিকিৎসার জন্য। শুধু চুয়াডাঙ্গা নয়, দেশজুড়েই শীতজনিত রোগী বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর ভিড়।

চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের বড় অংশই শিশু ও বৃদ্ধ। ঠাণ্ডার কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগ যেমন : নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের তথ্য বলছে, ঠাণ্ডার কারণে দেশে গত ১৪ নভেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৪৭ হাজার ৩৩ জন। এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৬৯ জনের। আর ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয় তিন লাখ ২২ হাজার ৬১১ জন। মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, শীতের প্রাক্কালে বাতাসের আর্দ্রতা কমে যায়। এর সঙ্গে ধুলাবালি বাড়ে। এতে ঠাণ্ডাজনিত রোগ যেমন : সর্দি-কাশি, অ্যাজমা, কোল্ড অ্যালার্জি, ফুসফুসের সমস্যা, শ্বাসকষ্টের বাধাজনিত রোগ, চর্ম রোগ, চোখের প্রদাহ ও ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে।

তিনি আরো বলেন, এ সময়ে বিশেষ করে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা। শিশুরা বেশি ভোগে, কারণ শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। দেখা যায়, ঠাণ্ডা থেকে কফ হয়েছে, কিন্তু কফ বের করার ক্ষমতা থাকে না। একইভাবে বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা এবং এই সময়ে বাতাসে ধুলাবালি বেশি থাকায় অনেকের অ্যালার্জি বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা দেখা দেয়। আর সেটি সঠিক সময়ে শনাক্ত না হলে অনেক সময় নিউমোনিয়াতেও তা রূপ নেয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৭৭৪ জন। আর এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৮৯৪ জন। তবে কারো মৃত্যু হয়নি।

জেলাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে নরসিংদী জেলায় পাঁচ হাজার ৩৪৪ জন। এরপর রয়েছে লক্ষ্মীপুর (৩,৫৮১), কক্সবাজার (২,৯১৭), ময়মনসিংহ (২,৮৩৪), চট্টগ্রাম (২,৫৩১) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া (২,২৬৬)। আর সবচেয়ে বেশি ৩২ জনের মৃত্যু হয় কক্সবাজার জেলায়। এ ছাড়া ময়মনসিংহে ১৮, খাগড়াছড়িতে ১৫ ও চুয়াডাঙ্গায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। একজন করে মারা গেছে ভোলা ও রাঙামাটিতে।

এদিকে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে টাঙ্গাইলে ৫৭ হাজার ৭৭২ জন। এ ছাড়া নরসিংদীতে ৩২ হাজার ৪৯৩ জন, গাজীপুরে ২৭ হাজার ৬২ জন, ফরিদপুরে ২৫ হাজার ৪৭ জন ও ঢাকায় ২০ হাজার ৮৪৪ জন ভর্তি হয়। ডায়রিয়ায় মৃত ১৩ জনের মধ্যে ১০ জনই নোয়াখালীর। এ ছাড়া দুজন চাঁদপুরের ও একজন লক্ষ্মীপুরের।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এই হাসপাতালে শীতজনিত রোগী বেড়েছে। শিশু ওয়ার্ডে নিউমোনিয়া রোগীর চাপ বেড়েছে। কেবিনসহ ২০টি শয্যার বিপরীতে শিশু ওয়ার্ডে রোগী থাকছে প্রায় তিন গুণ বেশি। প্রায় একই অবস্থা ডায়রিয়া ওয়ার্ডেও।

শিশুকন্যাকে নিয়ে হাসপাতালের মেঝেতে থাকা মমতাজ আরা বলেন, ‘মেয়ের নিউমোনিয়া হয়েছে। বাইরে থেকেও কিছু ওষুধ কিনতে হচ্ছে। হাসপাতালে রোগীর ভিড়। মেয়েকে নিয়ে মেঝেতে আছি।’
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. ফাতেহ আকরাম বলেন, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া রোগীর চাপ বেড়েছে। বয়স্করা শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। হাসপাতালে বিছানার তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকছে। ফ্লু কর্নার ও বহির্বিভাগেও চাপ বেড়েছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের অধ্যাপক কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, ‘এ সময় নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসকষ্টের রোগী বেশি পাচ্ছি। মনে রাখতে হবে, বুকে কফ জমে যাওয়া, শিশুর শ্বাসকষ্ট হওয়া, জ্বর বেশি আসা, জ্বরের মধ্যে খিঁচুনি হওয়া, জ্বরের পর কিছু না খাওয়া—এগুলো ঠাণ্ডাজনিত রোগের বিপদচিহ্ন।’

অধ্যাপক কামরুজ্জামান কামরুলের পরামর্শ—এ সময়ে শিশুদের নিয়ে বাইরে ঘোরাফেরা না করলে সবচেয়ে ভালো হয়। ঘরে থাকলেও যেন কোনোভাবে ঠাণ্ডা না লাগে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। গরম অনুভূত হয় এমন কাপড় পরিধান ও ধুলাবালি থেকে দূরে থাকতে হবে। সব সময় গরম খাবার খাওয়াতে হবে। ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/08/1221304