৮ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ৯:৪৫

বছরের শুরুতেই শিক্ষায় ভজঘট

বছরের শুরুতে বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে নতুন বই। কিন্তু সব শিক্ষার্থী তা পায়নি। যারা পেয়েছে তারাও সব বই পায়নি। এসব বইয়ের কাগজের মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। ঔজ্জ্বলতায় রয়েছে ঘাটতি। আবার শিক্ষার্থীদের যেসব বই দেয়া হয়েছে সেগুলোও ভুলে ভরা। করা হয়েছে ইতিহাস বিকৃতি। অন্যদিকে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই শুরু হয়েছে নতুন কারিকুলামে পাঠদান। সব মিলিয়ে বছরের শুরুতেই শিক্ষা ব্যবস্থায় ভজঘট পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, সংশ্লিষ্টদের এসব বিষয়ে আরও সতর্ক থাকা উচিত।

নতুবা শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হতে পারে। ২০১০ সাল থেকে সারা দেশে সরকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিয়ে আসছে। বছরের প্রথম দিন উৎসবের মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে এসব বই তুলে দেয়া হয়। কিন্তু চলতি বছর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সব শিক্ষার্থীর জন্য বই প্রস্তুত করতে পারেনি। প্রায় ৩৪ কোটি বই ছাপানোর উদ্যোগ নিলেও যথাসময়ে এসব বই প্রস্তুত হয়নি বলে সব শিক্ষার্থী বই পায়নি। যারা পেয়েছে তারাও সব বই পায়নি। এমনকি অভিযোগ পাওয়া গেছে এক শ্রেণির শিক্ষার্থীকে অন্য শ্রেণির বই দেয়ার। এনসিটিবি জানুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দেয়ার বিষয়ে আশাবাদী হলেও মুদ্রণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্চের আগে কোনোভাবেই সব বই ছাপানো সম্ভব নয়। অন্যদিকে এনসিটিবি এবার যেসব বই ছাপিয়েছে সেখানেও তথ্যগত ও ইতিহাসগত অনেক ভুল পাওয়া গেছে।
ভুলে ভরা এসব বই নিয়ে সমালোচনা থাকলেও কানে তুলতে নারাজ প্রতিষ্ঠানটি। তারা কেবল একটি ভুলই পেয়েছেন বলে জানান। গত বছরও পাঠ্যবইয়ে ভুলের জন্য এনসিটিবি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমালোচনা করেন হাইকোর্ট। চলতি বছর এনসিটিবি যেসব বই ছাপিয়েছে সেখানে দেখা যায়, বানান ভুলসহ তথ্যগত অনেক অসংগতি রয়েছে। বিশেষ করে অষ্টম ও নবম-দশম শ্রেণির বইয়ে ৩০টির অধিক ভুল রয়েছে। সমালোচনা হচ্ছে ইতিহাস বিকৃতির বিষয়গুলো। ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ে বলা হয়, ‘১২ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নিকট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।’ বইটির ২০০ নম্বর পৃষ্ঠায় ছাপানো এই তথ্যে রয়েছে ভুল। সঠিক তথ্য হলো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়িয়েছেন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। একই বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে।’ সঠিক তথ্য হলো- পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্যাতন, গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা শুরু হয় ২৫শে মার্চ কালরাতে। এই বইয়েই সংবিধানের আলোচনায় বলা হয়েছে, ‘পঞ্চম ভাগে জাতীয় সংসদ’। সঠিক তথ্য ‘পঞ্চম ভাগে আইনসভা’। একই শ্রেণির আরেক বইয়ে ‘পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আক্রমণ চালায় ও নৃশংসভাবে গণহত্যা ঘটায়’ উল্লেখ করা হয়েছে। বইয়ের ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় এমন তথ্য দেয়া হয়। যদিও রাজারবাগ ছিল পুলিশ লাইনস।

আর পিলখানায় ছিল ইপিআর সদর দপ্তর। অষ্টম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বইয়েও রয়েছে বেশ অসংগতি। এ বইয়ে দেশের ভয়াবহ বন্যার সালগুলো উল্লেখ থাকলেও ১৯৮৭, ২০০০, ২০০৭ ও ২০১৭ সালের বন্যার কথা নেই। এ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে অনেক ভুল রয়েছে। পাঠ্যবইয়ে ভুলের বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমরা ভুলগুলো দেখছি। কারেকশন করছি। এখানে ১৪টি ভুলের কথা বলা হলেও আমরা কেবল একটি ভুল আছে বলে মনে করছি। কারণ বাকিগুলোর আগে পরে আলোচনা করলে ঠিক আছে। তারপরও আমরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করছি। আমাদের রাইটাররা রয়েছেন। সবার সঙ্গে আলোচনা করে যেসব ভুল নির্ধারণ হবে সেগুলো কারেকশন করে দেব। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা যেন তাড়াতাড়ি পায় সেজন্য আমরা কারেকশনগুলোর সফট কপি উপজেলা পর্যায়ে পাঠিয়ে দেবো। তাদের বলে দেবো তারা যেন দ্রুত এগুলো প্রিন্ট করে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়। এদিকে চলতি বছর থেকে তিনটি শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম চালু করেছে সরকার। শ্রেণিগুলো হলো- প্রাক্‌ প্রাথমিক, ষষ্ঠ ও সপ্তম। কিন্তু এসব শ্রেণিতে পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি।

অথচ ২রা জানুয়ারি থেকে নতুন কারিকুলামে ক্লাস শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা অনলাইন ও অফলাইন দুই পদ্ধতিতে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিলেও এখনো অনেকে এর বাইরে রয়ে গেছেন। বিশেষ করে প্রাথমিকের শিক্ষকদের জন্য এখনো প্রশিক্ষণ চালুই হয়নি। আবার মাধ্যমিক পর্যায়ে যারা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তারাও সন্তুষ্ট নন। কারণ এসব প্রশিক্ষণের বেশির ভাগ হয়েছে অনলাইনে। ধীরগতির ইন্টারনেটের কারণে শিক্ষকরা প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন নি বলে জানান। মাধ্যমিকের মোট চার লাখ ৪১ হাজার ছয়জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া কিন্ডারগার্টেনগুলোর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে এনসিটিবি থেকে এ পর্যন্ত মোট ১৭ হাজার ৪৫৬ জন শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। অন্যদিকে প্রাথমিকের ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি স্কুলের তিন লাখ ৫৯ হাজার ৯৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা রয়েছে। যদিও এখনো এ প্রশিক্ষণ চালু হয়নি। অনলাইনে প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষকরা জানান, কিছু বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

দু’ একদিনের প্রশিক্ষণে বিস্তারিত শেখা সম্ভব নয়। তাই নতুন কারিকুলামে পাঠদানে কিছুটা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। মাধ্যমিকের প্রশিক্ষণের বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) প্রফেসর ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য মানবজমিনকে বলেন, আমরা প্রশিক্ষণ শেষ হলে বলতে পারবো কারা কারা এর বাইরে রয়েছেন। তখন আমরা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবো। যে কেউ অনলাইনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারবেন, যদি তার আইডি ও পাসওয়ার্ড থাকে। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে সবাইকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসবো। আর প্রাথমিকের প্রশিক্ষণের বিষয়ে এনসিটিবি সদস্য (প্রাথমিক) ড. একেএম রিয়াজুল করিম বলেন, আমরা প্রশিক্ষণের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রশিক্ষকদেরও সিলেকশন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা আমাদের প্রস্তুতির বিষয় মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে প্রশিক্ষণ শুরু হবে। আশা করছি, দিন পনেরোর মধ্যে আমরা প্রশিক্ষণ শুরু করতে পারবো। শিক্ষা ব্যবস্থার এ ভজঘট অবস্থা নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. মো. আব্দুস সালামের সঙ্গে। মানবজমিনকে তিনি বলেন, বিনামূল্যে বই একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। পৃথিবীর আর কোথায়ও এমন আছে কিনা আমার মনে হয় না। সরকারের পরিকল্পনা চমৎকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের বাস্তবতার কারণে হয়তো সময়মতো সব বই দেয়া সম্ভব হয়নি। আশা করি শিক্ষার্থীরা সব বই খুব শিগগিরই পেয়ে যাবে।

পাঠবইয়ে ভুলের বিষয়ে প্রফেসর সালাম বলেন, ভুল তথ্যের বিষয়টি দুঃখজনক। সংশ্লিষ্টদের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল। চেইন অব কমান্ড ও চেইন অব কারেকশনের বিষয়টা আরও গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল বলে মনে করি। পরবর্তীতে হয়তো সংশোধন হবে কিন্তু যে ভুল হয়ে গেছে সেটির তো একটি প্রভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া নতুন কারিকুলামে পাঠদানের বিষয়ে তিনি বলেন, আসলে এটি খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে। নতুন কারিকুলামের একটা ফিলোসফি রয়েছে। এখানে কেবল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিলে হবে না এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবারসহ সবাইকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তবেই এটি ফলপ্রসূ হবে। কিন্তু সে জায়গায় ঘাটতি রয়ে গেছে। এটি কোয়ালিটি এডুকেশনের ক্ষেত্রে অন্তরায়। আর সবগুলো বিষয়ে এক সঙ্গে নতুন কারিকুলামে যাওয়াও কতোটুকু ঠিক হয়েছে তাও ভাবা উচিত ছিল।

https://mzamin.com/news.php?news=37422