৮ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ৯:৩৪

দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে বাড়ছে জনরোষ

দেশের জনগণ এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কষাঘাতে হাবুডুবু খাচ্ছে। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নয়, ওষুধপত্রের দামও সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে’। এমন বক্তব্য সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমানের। উদাহরণ স্বরূপ তিনি বলেন, আমার পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনের ওষুধের পেছনে ব্যয় ছিল আগে ১০ হাজার টাকা। বর্তমানে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার টাকায়। সরকার কিছু ওষুধের দাম বেঁধে দিলেও খুচরা পর্যায়ে তা কার্যকর হচ্ছে না। ওষুধ কোম্পানিগুলো নানা অজুহাতে দাম বৃদ্ধি করে চলেছে। বিশ্ববাজারে ডলার, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে আমদানি করা ওষুধ যে যার মতো বিক্রি করছে। উচ্চমূল্য জোগাতে অপারগ হয়ে অনেকে ওষুধ সেবন বন্ধ করে দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, জনগণ রোগ প্রতিরোধে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার ও ওষুধ সেবন বন্ধ করলে দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। যা দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার বিরোধীতা এতদিন বিএনপিসহ সরকার বিরোধীরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করলেও এবার খোদ সরকার সমর্থিতরাই এটি স্বীকার করে বক্তব্য দিচ্ছে। অনেকেই বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি শুধু সরকার বিরোধীদের উপরই নয়, সবার উপরই পড়েছে। এর কষাঘাতে জর্জরিত সবাই। তাই নিজের জীবন বাঁচাতেই এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে সরকার সমর্থিতরাও সরব হয়ে উঠেছে।

সূত্র মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে বাড়ছে জনরোষ। বিগত কয়েক বছর ধরে বাজারে সব পণ্যের দামেই অস্বস্তি। দফায় দফায় বেড়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম। আর এসব অস্বস্তিতে জনগণ এখন ঘর ছেড়ে রাজপথমুখী হচ্ছে। জনমনেও বাড়ছে সরকারবিরোধী ক্ষোভ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিই এখন দেশের রাজনীতিতে প্রধান ইস্যু। তাই সব রাজনৈতিক দল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ করায় ফের সরব হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। জনসম্পৃক্ত এসব বিষয়কে সামনে সরকারবিরোধীরা জোরালো আন্দোলনের পথে হাঁটছে। এরই মধ্যে বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশ করেছে। যুগপৎভাবে পালিত হয়েছে গণমিছিলও। আগামী ১১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে অবস্থান কর্মসূচি। যদিও এসব কর্মসূচির মধ্যে অন্যান্য দাবিও রয়েছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে মাঠের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল। তারা সারাদেশেই সভা-সমাবেশ করছে। সঙ্গে যোগ দিচ্ছে তাদের জোট শরিকরা। বাদ যায়নি সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও। বসে নেই বামদল। হরতাল পালনের ঘোষণা দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। ইসলামী দলসহ ছোট দলগুলোও তাদের মতো করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এ কারণে স্বস্তিতে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। এমনকি সরকারদলীয় জোটের শরিকরাও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে অসন্তুষ্ট। সরকারবিরোধী দলগুলোর নেতারা বলছেন, এ সরকার মানুষের কষ্ট বোঝে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরিব মানুষ হাহাকার করছেন। অথচ সরকারের লুটপাট আর দুর্নীতির কারণেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। বাজার চড়া হতে হতে এখন জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। রমযানের আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে সহনীয় পর্যায়ে না আনা হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশের বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে এক শ্রেণির সরকার সমর্থিত ব্যবসায়ী খাদ্য মজুদ করে বাজার অস্থিতিশীল করছে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য এটি চরম দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, শান্তিশৃঙ্খলা, সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে কঠোর আন্দোলনের মধ্যে বর্তমান সরকারকে হটানো ছাড়া বিকল্প পথ দেখছেন না তারা। আওয়ামী লীগকে আর ছাড় দিতে রাজি নন তারা। ক্ষমতাসীনদের পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে রূপ দিতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে পাশে চায় নেতারা।

কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, একদিকে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে মানুষকে বিপদে ফেলছে। অন্যদিকে, এক শ্রেণির মানুষ কৌশলে মানুষের অর্থ লুট করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় করছে।

এ ছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়া মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা হচ্ছে না। নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন করতে সরকারকে বাধ্য করার জন্য আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
এদিকে, বাম সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মানুষ নিদারুণ অর্থ ও খাদ্য সংকটে আছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সিপিবি সারা দেশে কর্মসূচি পালন করছে। জানতে চাইলে সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, চাল, তেল, পেঁয়াজসহ ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে দেশের বাজারে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির ফলে টিসিবির পণ্য বিক্রির ট্রাকের সামনে দীর্ঘ হচ্ছে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত মানুষের লাইন। নিম্নবিত্তের অবস্থা তো আরো করুন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরিব মানুষ হাহাকার করছে। তবে এ সরকার বধির, গরিবের হাহাকার সরকারের কানে যায় না। মন্ত্রীরা নানারকম কথা বলে মানুষের দুঃখ কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়ের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকার পতনে বৃহৎ কর্মসূচি ঘোষণা করার হুঁশিয়ারি দেন। সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবে তার দল।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদ্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকারের লুটপাট আর দুর্নীতির কারণেই দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। কোথাও সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকারের সিন্ডিকেটগুলো কৃত্রিমভাবে সব পণ্যর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর দুর্নীতির কারণে এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যে জিনিসপত্রের দাম প্রতিটি ক্ষেত্রে ৩০-৪০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের চরম দুর্নীতির প্রভাব বাজারে গিয়ে পড়ছে এবং জনগণকে তার মাশুল দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা তখনই সম্ভব হবে যখন দেশে গণতান্ত্রিক সরকার হবে। তাই জনগণ আর বসে থাকবে না, গণআন্দোলনে ভেসে যাবে ‘অবৈধ’ শাসকগোষ্ঠী। আগামীতে জনগণের প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবকিছুর দাম বাড়লেও বাড়ছে না কেবল মানুষের আয়। এ অবস্থায় শহুরে জীবনে টিকে থাকা দায় হয়েছে। এই অবস্থায় ভালো নেই মধ্য আয়ের কর্মজীবী মানুষ। এরাই এখন সবচে দুঃসময়ে। মানুষের দুঃসময়ে শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়, জীবন-যাপনে প্রয়োজনীয় সবকিছুর দামই হু হু করে বাড়ছে। এতে নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্য আয়ের মানুষেরও। মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করা ব্যক্তিরাও এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাসা ভাড়া, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, অফিসে যাতায়াতসহ সংসারের যাবতীয় খরচের সঙ্গে যোগ হয়েছে নিত্যপণ্যের লাগামহীন বাড়তি মূল্য। রমযান মাস সমাগত। অথচ বাজার অস্থির হয়ে আছে। যেটা মোটেও কাক্সিক্ষত নয়। বাংলাদেশে একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে আর কমতে চায় না, এটা যেন স্বাভাবিক নিয়মে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে এমন ঘোষণায় দাম বাড়ে বারে বারে এবারে রমজান ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পণ্য মূল্য আবার বাড়লে মানুষ আরও অসহায় হয়ে পড়বে। তারা বলছেন, দেশের একটি অনিয়ম নিয়ম হয়ে গেছে, রমজানের সময় মূল্য বেড়ে যায়। কেন বাড়ে, কারা বাড়ায় এটা দেখভাল করার কেউ আছে বলে আমাদের মনে হয়না। এবারও হয়ত বাড়বে। তারপর কী হবে তা জানে না কেউ। সরকার বিভিন্ন বিষয়ে নজর দেয়ার কথা বললেও সিন্ডিকেটকে কোনোমতে ভাঙা যাচ্ছে না। এভাবে দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকলে মানুষ যাবে কোথায়?

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চড়া সবকিছুই। চাল, ডাল, নুন, তেল, শাকসবজি, তরিতরকারি ইত্যাদির চড়া দাম অব্যাহত। মাছ-মাংস, দুধ-ডিম, মুরগি-খাসি সবকিছুতেই লেগেছে মূল্যস্ফীতির ছোঁয়া। সরকারি হিসাবেই ২০২২ সালের জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার যেখানে ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ, সেখানে নভেম্বরে তা ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশে উন্নীত হয়। নজিরবিহীন মূলস্ফীতি বিগত অনেক বছরের মধ্যে। কিন্তু সমস্যা মূল্যস্ফীতি নয়, কম হারে মজুরি বৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি মজুরি বৃদ্ধি সমানভাবে হলে কোনো সমস্যা ছিল না। তা হয়নি। গত অক্টোবরে মজুরি বৃদ্ধি ঘটেছে মাত্র ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ হারে। ব্যবধানের কারণে গরিব মানুষ ও মধ্যবিত্তের জীবন ২০২২ সালে কেটেছে অতিকষ্টের মধ্যে। দেখা যাচ্ছে, মধ্যবিত্তের আয়ের একটা উৎস ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার-তার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

অর্থনীতি বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. আর এম দেবনাথ বলেন, সহসা মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে, উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, তেলের দাম কমবে, গ্যাসের দাম কমবে, ডলার সংকট কাটবে, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে-এমন ধারণা করা যায় না। দুঃখ দুর্দশাকে সাথে নিয়েই বাঁচতে হবে সাধারণ মানুষকে।

https://dailysangram.com/post/513081