৫ জানুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ২:৩৮

চিকিৎসার লাগামহীন ব্যয়ে নিঃস্ব মানুষ

ছয় মাস আগে অস্বাভাবিক জ্বর দেখা দেয় ঝিনাইদহের গোপালপুর গ্রামের আমেনা বেগমের। কয়েকবার জেলা সদরের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয়নি। শেষে চিকিৎসকের পরামর্শে রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসক জানান, তাঁর ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে। তিন মাস ধরে এ হাসপাতালেই চলেছে চিকিৎসা।

আমেনা বেগমের স্বামী আতিয়ার মোল্লা পেশায় কৃষক এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এরই মধ্যে আমেনার চিকিৎসায় লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। ব্যয় মেটাতে শেষ সম্বল ৬ কাঠা জমিও বিক্রি করেছেন তাঁরা। আমেনার স্বামীর হাতে আর কোনো টাকা নেই। বাধ্য হয়ে চিকিৎসা শেষ না করেই হাসপাতাল ছেড়েছেন।

সরকারি সংস্থা স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা বলছে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজের ব্যয় ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে। চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যক্তি নিজেই বহন করেন। আর এ ব্যয় করতে গিয়ে বছরে ৮৬ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে।
গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দেশে মানুষের চিকিৎসা খাতে ব্যক্তিগত ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেনসেস) আরও বেড়েছে। এ অতিরিক্ত ব্যয় ২০১৫ সালে ছিল ৬৭ শতাংশ, যা ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে ৬৯ শতাংশে। ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে ব্যক্তির নিজ খরচে।

গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে ওষুধ কিনতে। এতে ব্যয় ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ছাড়া রোগ শনাক্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, বিকল্প চিকিৎসাসেবায় ১৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং হাসপাতালে খরচ ১০ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৯ সালের তুলনায় এ বছর হাসপাতাল ও বিকল্প চিকিৎসাসেবা নেওয়ায় ব্যয় বেড়েছে। এসব ব্যয়ের মধ্যে সরকার ও দাতা সংস্থা থেকে আসে ৩১ শতাংশ। শুধু সরকার বহন করে ২৩ দশমিক ১ শতাংশ।

গতকাল বুধবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের আয়োজনে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস-ষষ্ঠ রাউন্ডের চূড়ান্ত ফলাফল অবহিতকরণ কর্মশালায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থার প্রতিনিধি, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।

স্বাস্থ্য খাতের আর্থিক বিবরণ নিয়ে এ প্রতিবেদনে ১৯৯৭ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮, '১৯ ও '২০ সালে সরকারের অংশ ছিল যথাক্রমে মোট ব্যয়ের ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের অংশ ক্রমান্বয়ে কমছে। আবার ওই বছরগুলোতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসা করাতে গিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাড়ছে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের তথ্যে দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবা দিতে ২০২০ সালে সরকারের মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৫৪ ডলার বা ৪ হাজার ৫৭৮ টাকা। বর্তমানে সরকার স্বাস্থ্যসেবায় যে অর্থ ব্যয় করে তার সবচেয়ে বেশি হয় ঢাকা বিভাগে, মোট ব্যয়ের ৩৭ শতাংশ। সবচেয়ে কম ৩ শতাংশ ময়মনসিংহ বিভাগে। মাথাপিছু হিসাবে ঢাকা বিভাগের জনপ্রতি ব্যয়ের পরিমাণ ৭ হাজার ৩৯ টাকা এবং ময়মনসিংহে ২ হাজার ৬০ টাকা।

উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে চিকিৎসাসেবা বিনামূল্যে দেওয়া হয়। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে চিকিৎসায় রোগীর নিজস্ব ব্যয় সবচেয়ে বেশি আফগানিস্তানে; দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এর পর রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও নেপাল। সবচেয়ে কম ব্যয় মালদ্বীপে।

চিকিৎসায় রোগীর নিজস্ব ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ওই বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। সেখানে ২০৩২ সালের মধ্যে রোগীর নিজস্ব ব্যয় ৩২ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে দীর্ঘ এক যুগেও এ ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। ব্যক্তির ব্যয় কমেনি, বরং বেড়েছে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস সেলের ফোকাল পারসন ডা. সুব্রত পাল ষষ্ঠ রাউন্ডের প্রাপ্ত ফলাফল তুলে ধরেন। তিনি বলেন, রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় সবসময় সরকারের ব্যয় বা সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। দেশের শীর্ষ ধনীরা চিকিৎসার ব্যয়ের ৫৪ শতাংশ বহন করেন।

অনুষ্ঠানে ইউনিসেফের ঢাকা কার্যালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান মায়া ভ্যানডেনেন্ট বলেন, নিজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অনেকে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। এর ফলে অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা বলেন, ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বেশি হলে তা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বাধা। শুধু অর্থায়নই সমস্যার সমাধান নয়; অর্থের যথাযথ ব্যবহারও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, এই প্রতিবেদনের তথ্য সরকারের নীতি-কৌশল প্রণয়ন এবং সেবার মান বাড়াতে কাজে লাগবে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি বদলাতে পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি জোরদারের পাশাপাশি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

জাহিদ মালেক বলেন, স্বাস্থ্য খাতে ৩৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ব্যয়সহ খরচ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের ব্যয় শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের চেয়েও কম। আমরা হয়তো জিডিপির শেয়ার কম পাচ্ছি। এটা বাড়ানো দরকার। পকেটের অর্থ খরচ কমাতে হলে প্রাইভেটের খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আবার বিদেশে বড় একটা অংশ চিকিৎসা নেয়। সেটিরও একটা প্রভাব এতে পড়ে।

অনুষ্ঠানে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে কাঁচামাল আনতে সমস্যা হচ্ছে। এতে ওষুধের দাম বাড়াতে আমাদের ওপর চাপ রয়েছে। চাপ সামাল দিতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। একই সঙ্গে সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের দেওয়া বিভিন্ন উপহার কমিয়ে দিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ সমকালকে বলেন, ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে কোম্পানিগুলোকে সরকারি ফরমুলা অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমানে ১৫০টি ওষুধের দাম সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়।পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি, দুর্নীতি কমানো ও নজরদারি বাড়ানো দরকার। তিনি বলেন, শুধু ওষুধ নয়; রোগ শনাক্তের খরচের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বেড়েছে। হাসপাতালে অবস্থান ও যাতায়াত খরচও বেড়েছে। গত ছয় মাসে দুই দফায় ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া ফার্মেসিগুলোতে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধে সরকারের আরও শক্ত হতে হবে।

https://www.samakal.com/bangladesh/article/2301149649