৩ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:০৭

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য নীরব রক্তক্ষরণের বছর

২০২২ সাল ছিল বিনিয়োগকারীদের জন্য দুঃস্বপ্নের বছর। লাভের পরিবর্তে বিনিয়োগ করা পুঁজি হারিয়েছেন অধিকাংশ বিনিয়োগকারী। এমনকি দিনের পর দিন ধরে লোকসানে শেয়ার বিক্রির চেষ্টা করেও অনেকে বিনিয়োগকারী ক্রেতা পাননি। ফলে বছরের সিংহভাগ সময় বিনিয়োগকারীদের হতাশায় কেটেছে। ফলে ২০২২ সাল ছিল বিনিয়োগকারীদের নীরব রক্তক্ষরণের বছর। বছরটি শেয়ারবাজারের জন্য খারাপ গেলেও বছরের শুরু হয়েছিল আশাজাগানিয়া। ২০১০ সালের মহাধসের পর এবছর ছিল শেয়ারবাজারের খারাপ সময়।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালের প্রথম কার্যদিবসে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক বেড়েছিল ৯৬ পয়েন্ট। বছরের প্রথম দিন এমন বড় উত্থানের পর জানুয়ারিজুড়েই ঊর্ধ্বমুখী থাকে শেয়ারবাজার। মূল্যসূচক বাড়ার পাশাপাশি লেনদেনের গতি বৃদ্ধি পায়। জানুয়ারি মতো ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেও বেশ ভালো অবস্থানে ছিল শেয়ারবাজার। একদিকে শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়তে থাকে, অন্যদিকে বাড়ে লেনদেনের গতি। ফলে স্বতঃস্ফূর্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে মুনাফা তুলে নিতে থাকেন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বদলে যায় চিত্র। ভয়াবহ দরপতনের কবলে পড়ে শেয়ারবাজার। সেই পতনের ধকল থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেনি দেশের শেয়ারবাজার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর শেয়ারবাজারে এত বড় ধাক্কা লাগে যে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের সর্বনি¤œ দাম (ফ্লোর প্রাইস) বেঁধে দেয়া হয়। এতে নতুন করে দাম কমার পথ আটকে যায়। কিন্তু দেখা দেয় লেনদেন খরা। দুই হাজার কোটি টাকায় উঠে যাওয়া লেনদেন কমে তিনশ কোটি টাকার নিচে নেমে অসে। ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিনিয়োগকারীদের বড় লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করলেও, সেই ফ্লোর প্রাইসই হয়ে ওঠে বিনিয়োগকারীদের গলার কাঁটা। অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম ফ্লোর প্রাইসে আটক যায়। বিনিয়োগকারীরা শত চেষ্টা করেও ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকা এসব শেয়ার ও ইউনিট বিক্রি করতে পারেননি। এতে একদিকে বিনিয়োগ আটকে গেছে, অন্যদিকে বন্ধ হয়েছে নতুন বিনিয়োগের পথ।

বছটির মূল্যয়ন জানতে চাইলে বিনিয়োগকারীরা জানান, ২০২২ সাল মোটেও ভালো যায়নি আমাদের। যখন যে শেয়ার কিনেছি, তাতেই লোকসান হয়েছে। এতো খারাপ বছর আর কখনো দেখিনি। এখন তো লোকসানে শেয়ার বিক্রির চেষ্টা করেও ক্রেতা পাচ্ছি না। আমাদের কাছে থাকা অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার এবং মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। এ থেকে কবে মুক্তি পাবো জানি না। বছরের শুরুর দিকে কিছুটা মুনাফা হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আর লাভের মুখ দেখিনি।

বরং আগে যে লাভ হয়েছিল, সেই লাভ তো গেছেই; সঙ্গে মূল বিনিয়োগের পরিমাণও কমে গেছে। সব মিলিয়ে এখন আমরা বড় লোকসানে আছি। আবার লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠানের শেয়ারও বিক্রি করা যাচ্ছে যায়নি। কারণ শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসে আটকে ছিল। প্রতিদিন বিক্রির আদেশ বসিয়েছি, কিন্তু বিক্রি হয়নি। এভাবেই বছর পার হয়ে গেছে।

প্রতিনিয়ত নীরবে আমাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কমেছে সামাজিক মর্যাদা। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মনিরুজ্জামান এক অনুষ্ঠানে জানান, এ বছর শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা লাভের মুখ দেখেননি। বরং গত বছর যে লাভ হয়েছিল, এ বছর সেটা হারিয়ে ফেলেছেন। আমরা শেয়ারবাজারে এমন জোয়ার-ভাটার খেলা দেখতে চাই না।

বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম জানিয়েছেন, ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়েছিল সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে। সারা পৃথিবীতে শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৮০-৯০ শতাংশ। আমাদের দেশে ঠিক উল্টো। যেখানে ৮০ শতাংশ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, সেখানে আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতেই হবে। সে কারণে আমরা ফ্লোর প্রাইস দিয়ে সাময়িক একটা ব্যবস্থা নিয়েছিলাম।
এদিকে গত বছরের প্রথম কার্যদিবস ২ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ৮৫৩ পয়েন্ট। সেখান থেকে তা বেড়ে ১১ জানুয়ারি ৭ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করে। এরপর ২০ জানুয়ারি সূচক আরও বেড়ে ৭ হাজার ১০৫ পয়েন্টে উঠে আসে। এটি ২০২২ সালে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচকের সর্বোচ্চ অবস্থান। মধ্য ফেব্রুয়ারিতেও ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ৭ হাজার পয়েন্টের ওপরে ছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আর ৭ হাজার পয়েন্ট ওঠেনি মূল্যসূচক। বছর শেষে (২৯ ডিসেম্বর) ডিএসইর প্রধান সূচক ৬ হাজার ২০৬ পয়েন্টে অবস্থান করে। দরপতনের পাশাপাশি লেনদেন খরার মধ্যে পড়ে শেয়ারবাজার। ২০২২ সালের শুরুর দিকে শেয়ারবাজারে নিয়মিত হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হলেও বছর শেসে তিন’শ কোটি টাকার ঘরে নেমে আসে। শেষ কার্যদিবস ২৯ ডিসেম্বর ডিএসইতে লেনদেন হয় ৩৪৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২ সালে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৫৪৯ দশমিক ৮৫ পয়েন্ট বা ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক কমেছে ৩৩৭ দশমিক ২৮ পয়েন্ট বা ১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। শরিয়াহ্ ভিত্তিতে পরিচালিত ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক কমেছে ৭২ দশমিক ২৯ পয়েন্ট বা ৫ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। মূল্যসূচকের বড় পতনের সঙ্গে দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা। ২০২১ সালে ডিএসইতে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয় ১ হাজার ৪৭৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। ২০২২ সালে তা কমে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৯৬০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ, আগের বছরের তুলনায় প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন কমেছে ৫১৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বা ৩৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জানান, ডলারের দাম বেড়েছে, আমদানি কমেছে। অর্থনীতি হয়তো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। তার চেয়ে বড় কথা ব্যাংকের তারল্য সংকট সহজে কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। এমন অবস্থায় ২০২৩ সাল খুব উজ্জ্বল একটি বছর যাবে বলে আমার মনে হয় না। তবে বাজার যদি স্বাভাবিকভাবে চলতে দেয়া হয়, তাহলে ধীরে ধীরে বর্তমান যে অবস্থা, সেখান থেকে উত্তরণ হবে। আর বাজারে যদি ফ্লোর প্রাইস ধরে রাখা হয়, তাহলে এরকমই (বর্তমান অবস্থার মতো) থাকবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যতদিন ফ্লোর প্রাইস থাকবে, ততদিন বাজারে একটা নেতিবাচক প্রেশার থাকবে। কারণ পিই হিসাব করা হয় দাম এবং আয় দিয়ে। আয় কিন্তু পড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি দুর্বল হতে থাকলে, আয় অবশ্যই পড়বে। অপরদিকে ফ্লোর প্রাইসের কারণে দাম কমতে পারছে না। যতদিন ফ্লোর প্রাইস থাকবে, ততদিন কৃত্রিমভাবে পিই বেড়ে যাবে। আয় পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু দাম একই থেকে যাচ্ছে, সুতরাং ক্যালকুলেশনে পিই ১৭-১৮ হয়ে যাচ্ছে। তখন কিন্তু বোঝায় বাজার অতিমূল্যায়িত এবং এটা কৃত্রিম। বাজার ইতিবাচক হওয়ার একটাই উপায় আছে। সেটা হলো স্টকের দাম ফেয়ার ভ্যালু হতে হবে। এখন কিন্তু আপনি বলতে পারবেন না, কোনো স্টক ফেয়ার ভ্যালুতে আছে। কৃত্রিমভাবে দাম ধরে রাখা হয়েছে। স্টকের মূল্য যখন ফেয়ার ভ্যালুতে আসবে, তখন সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারী আসবে।

এদিকে পতনের বাজারে ২০২২ সালজুড়ে ছিল আইপিও খরা। এ বছর ছয়টি প্রতিষ্ঠান আইপিও’র মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করেছে। শেয়ারবাজার থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো ৬২৬ কোটি ২৬ লাখ ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে। ২০২১ সালে আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা প্রতিষ্ঠান ছিল ১৪টি। প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে অর্থ উত্তোলন করে এক হাজার ২৩৩ কোটি ২৬ লাখ ৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ আইপিওতে আসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে ৮টি। অর্থ উত্তোলন কমেছে ৬০৬ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।

এাছাড়া বছর শেষে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৬টিতে। এর মধ্যে পুরুষ বিনিয়োগকারীদের ১৩ লাখ ৮৮ হাজার ৪৬৯টি এবং নারীদের ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৬০৭টি। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ১৭ লাখ ৮০ হাজার ১০৫টি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ৬২ হাজার ৯১৭টি। অপরদিকে, বছরের শুরুতে বিও হিসাব ছিল ২০ লাখ ৩৪ হাজার ৫৩৯টি। এর মধ্যে পুরুষ বিনিয়োগকারীদের ১৫ লাখ ১১ হাজার ৮২৬ এবং নারীদের ৫ লাখ ৭ হাজার ৩৬১টি। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ১৯ লাখ ৩২ হাজার ৮২৬ এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ৮৬ হাজার ৩৬১টি। এ হিসাবে বিও হিসাব কমেছে এক লাখ ৯১ হাজার ৪৬৩টি। এর মধ্যে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে এক লাখ ৫২ হাজার ৭২১টি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে ২৩ হাজার ৪৪৪টি। কমে যাওয়া বিও হিসাবের মধ্যে পুরুষ বিনিয়োগকারীদের এক লাখ ২৩ হাজার ৩৫৭টি। এছাড়া নারী বিনিয়োগকারীদের ৫২ হাজার ৭৫৪টি বিও হিসাব কমেছে। বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান জানান, আগামী বছর (২০২৩ সাল) এ বছরের (২০২২ সাল) থেকে ভালো হবে। এবছর সব ধরনের নেতিবাচক অ্যাক্টিভিটি গেলো। কোভিডের পর যুদ্ধ, যুদ্ধের পর ডলার সংকট। সবকিছুই নেতিবাচক। আশা করি আগামী বছর ভালো হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, রপ্তানি বাড়ছে। সে হিসেবে আগামী বছর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকবে। আশাকরি পুঁজিবাজারও ভালো থাকবে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের উচিত জেনে-বুঝে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করা। কারও দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, গুজবের ওপর নির্ভর না করে, জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। গুজবনির্ভর বিনিয়োগ পুঁজি ধ্বংস হওয়ার কারণ।

https://dailysangram.com/post/512591