৩ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:০০

আজানের বিরোধিতা ও আমাদের অবস্থান

-ড. মো. নূরুল আমিন

আজানকে নিয়ে আমার জীবনের অবিস্মরণীয় একটি ঘটনা আছে যা প্রায়শই আমার স্মৃতিকে নাড়া দেয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (Food and Agricultural Organisation-FAO) সৌজন্যে আমি ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কৃষি উন্নয়নে সমবায়ের ভূমিকা শীর্ষক একটি সেমিনারে যোগদানের জন্য চীনের রাজধানী বেইজিং সফরে গিয়েছিলাম। এয়ারপোর্টে পৌঁছার পর চীন সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা আমাকে বেইজিং এর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হোটেল নভোটলে নিয়ে যান এবং হোটেলের ১১১২ নং কক্ষে আমাকে তুলে দেন। তখন দুপুর প্রায় ১২টা। আমি কাপড় চোপড় গুছিয়ে হাত মুখ ধুয়ে কিছুক্ষণের জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চিন্তার মগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। চীনারা ইংরেজীতে খুবই দুর্বল; সেমিনারে আগত অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সাথে এখনো দেখা হয়নি। নভোটল রেঁস্তোরায় খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে, তবে অমুসলিম দেশে এসব রেঁস্তোরায় হালাল খাবার পাওয়া খুবই মুশকিল। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে কেবলা নিয়ে। হোটেল কক্ষে কেবলার কোনও দিক নির্দেশনা নেই, নামায পড়বো কিভাবে। এসব চিন্তার মাঝে হঠাৎ রুমের বেল বেজে উঠলো। ভাবলাম হয়ত ওয়েটার বা রুম বয়দের কেউ খোঁজ নিতে এসেছে। বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দিলাম। সামনেই দেখলাম একজন পুরুষ ও একজন মহিলা আমাকে সালাম দিলেন। সালামের জবাব দিলাম এবং আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই তারা বললেন তারা উভয়ের মালয়েশিয়া থেকে এসেছেন। একজন ড. হালিমা মালেশিয়ান সরকারের কৃষি মস্ত্রণালয়ের সিনিয়র ডেপুটি সেক্রেটারি, আরেকজন হাজী ইসমাইল ঐ সরকারের সমবায় বিভাগের রেজিস্টার বা নিবন্ধক।

তারা দুজনই সেমিনারে এসেছেন এবং হোটেল রেজিস্টারে আমার নাম ও রুম নং দেখে এবং মুসলমান জেনে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। ভেতরে এনে বসালাম এবং কুশল বিনিময়ের পর পারস্পরিক পেশাগত অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হলাম। এর মধ্যে ড. হালিমা আমি জোহরের নামায পড়েছি কিনা জানতে চাইলেন। আমি বললাম এখনো পড়িনি; কেবলা ঠিক করতে পারিনি। মনে হলো তিনি এই সমস্যার সমাধান নিয়েই এসেছেন। তার সাথে কম্পাস ছিল, তিনি তা দিয়ে আমার কক্ষের কেবলা ঠিক করে দিলেন এবং দুপুরের খাবার কোথায় খাবো জানতে চাইলেন। আমি হালাল খাবারের সমস্যার কথা বললাম। তারা জানালেন যে তারা নিজ নিজ কক্ষে নামায পড়েছেন এবং দুপুরের খাবারের জন্য হোটেল থেকে কিছু দূরে একটি হালাল রেঁস্তোরায় যাচ্ছেন। আমি যদি আগ্রহী হই তাদের সাথে যেতে পারি, আমি আগ্রহ প্রকাশ করলাম। তারা আমাকে নামায পড়ার সময় দিয়ে লবিতে আসার অনুরোধ করে বলে গেলেন। নামায পড়ে দশ মিনিটের মধ্যেই আমি লবিতে তাদের সাথে একত্রিত হলাম এবং পায়ে হেঁটে হালাল রেঁস্তোরার পথে চললাম। প্রায় ১৫ মিনিট হাঁটার পর Diplomatie Zone এর পাশে একটি স্থানে থামলাম। তারা বললেন যে, এটা চীনা মুসলমানের পরিচালিত একটি কমপ্লেক্স। বিশাল সাইবোর্ড দেখলাম ইংরেজীতে লেখা আছে (“Al-Emaret: Markaze Tezarate Islami Bank, Beijing’’) অর্থাৎ বেইজিং ইসলামী ব্যাংকের বাণিজ্যিক হেড কোয়ার্টার। হেড কোয়ার্টারের পাশেই আরো বিশাল বিশাল কয়েকটি ভবন। একটি সমজিদে একটি আবাসিক মাদ্রাসা, একটি রেঁস্তোরা ও একটি শপিং সেন্টার এবং একটি কমিউনিটি হল। পেটে ক্ষিধা থাকা সত্ত্বেও কমপ্লেক্সটি ঘুরে দেখার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। ঘুরে ফিরে দেখে রেঁস্তোরায় এসে বসলাম। মালয়েশিয়ান ভদ্রলোক ও ভদ্র মহিলার কোন সমস্যা ছিল না, তারা দেখতে চীনাদের মতো। আমি ব্যতিক্রম। আমাকে রেঁস্তোরা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি বাংলাদেশী মুসলমান। চীনারা বাংলাদেশ বলতে পারে না, বাঙ্গালাদেশ বলে। তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাইলো। আমি বললাম যে, তিন দিকে ভারত ও একদিকে বার্মা ও বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত একটি ভূখ-ে আমরা বসবাস করি যার নাম বাংলাদেশ। আমাদের জনসংখ্যা ১৩ কোটি (তখন) এবং এর ৯২ শতাংশই মুসলমান। প্রতিদিন ভোরে আজানের শব্দ শুনে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে এবং আমাদের দেশে প্রায় তিন লক্ষ মসজিদ আছে। আমার কথা শেষ হতে না হতেই তারা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে সারা রেঁস্তোরা প্রকম্পিত করে তুললো। আশপাশে কমপ্লেক্সের অন্যান্য ভবনে এই খবর ছড়িয়ে পড়লো। আমাকে একনজর দেখার জন্য রেঁস্তোরা ভর্তি হয়ে গেল। তারা অবাক হয়ে বলতে লাগলো যে, বাংলাদেশের মুসলমানরা কত ভাগ্যবান; আজানের আওয়াজে তাদের ঘুম ভাঙ্গে। সেদিন তাদের উচ্ছ্বাসে আমিও উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলাম। আসলে আমরা কতই না ভাগ্যবান! আল্লাহ আমাদের একটি মুসলিম ভূখ-ে জন্ম দিয়েছেন। কথাটা মনে পড়লো চট্টগ্রামের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

কয়েকদিন আগে বন্দর নগরীর এক শিল্পপতি ও তার স্ত্রী (দুজনের নামের শেষেই খান শব্দটি আছে) সেখানকার এক মসজিদের আজানে বিরক্ত হয়ে মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে এই বিরক্তিকর আওয়াজ বন্ধ না করলে মসজিদকে দেয়া তার সকল আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ করে দিবেন বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। এই দম্পতির নাম দেখে তাদের উভয়কে মুসলমানের বাচ্চা বলেই মনে হয়েছে। খবরটি শুনে খুবই বিস্মিত হলাম। মুসলমান হয়ে আজান শুনে বিরক্ত হন, ঘুমাতে পারেন না, এটা বিস্ময়করই বটে। ভদ্রলোক একজন শিল্পপতি বলে পত্রপত্রিকায় খবর এসেছে। তিনি কী ধরনের শিল্পপতি সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। আমাদের দেশে যারা শিল্প কারখানার মালিক ও প্রচুর অর্থবিত্ত করেছেন তাদের মধ্যে প্রকারভেদ রয়েছে। এক. যারা পরিশ্রম করে সততা, যোগ্যতা ও দক্ষতার বলে তিল তিল করে অর্থবিত্ত গড়ে ধনী হয়েছেন। এদের বেশির ভাগই বিনয়ী ও খোদাভীরু। দুই. যারা মাটি কাটার ঠিকাদারী ও মাটি চুরি করে টাকা রোজগার করে বড়লোক হয়েছেন এবং পরে প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার হিসেবে বৃহত্তর অঙ্গনে বৈধ অবৈধ উপার্জনের সুযোগ নিয়েছেন। তিন. বাংলাদেশ হবার পর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অবাঙ্গালী মুসলমানদের বাড়িঘর ও কলকারখানা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে বিত্তশালী হয়েছেন। এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। আল্লাহর প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা নেই। নামে মুসলিম হলেও কাজে তারা বিধর্মী থেকেও নিকৃষ্ট। সারা রাত নাইট ক্লাব ও শরাবখানায় কাটিয়ে শেষ রাতে মাতাল অবস্থায় তারা ঘুমাতে যান। এ ক্ষেত্রে আজানের আওয়াজ তাদের ঘুমের ব্যঘাত তো ঘটাবেই।

আজানের সাথে মুসলিম জীবন ও জীবনাচারের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মুসলিম পরিবারে একটি শিশু জন্মের সাথে সাথে কানে আজান দিয়ে তাকে দুনিয়াতে খোশ আমদেদ জানানো হয়। আজানে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, একত্ববাদ ও মুহাম্মদ (সা.)-এর রেসালাত ঘোষণা করা হয়। এর মাধ্যমে সালাত ও কল্যাণের জন্য মসজিদে আসার দাওয়াত দেয়া হয়। আজানের ধ্বনি যে কোনও এলাকায় মুসলমানদের অস্তিত্বের পরিচায়ক। যেমন নামায মুসলমান ও অমুসলমানের মধ্যে পার্থক্যের সূচক তেমনি আজানও কোন এলাকায় মুসলমান আছে তার নিয়ামক। অমুসলিম দেশে-আমরা যখন সফরে যাই-তখন প্রচ-ভাবে আজানের অভাব অনুভব করি। এ সব দেশের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মুসলমানদের তৈরি কিছু কিছু সমজিদ আছে, আবার খৃষ্টানদের পরিত্যক্ত অনেক গির্জাও মসজিদে রূপান্তর হতে দেয়া গেছে। এসব দেশের অধিকাংশ ক্ষেত্রে আজান মসজিদের অভ্যন্তরে সামীবদ্ধ থাকলেও অধুনা কোন কোন দেশে প্রকাশ্যে আজান দেয়ার অনুমতি প্রদান করা হচ্ছে। আজানের সুমধুর কণ্ঠ-অনেক অমুসলিমের কানে সুরের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করার নজিরও সম্প্রতি সৃষ্টি হয়েছে। অতিসম্প্রতি কাতারে অনুষ্ঠিত ফুটবলের বিশ্বকাপ খেলায় আগত পশ্চিমা দেশের লক্ষ লক্ষ দর্শক তার প্রমাণ। পত্র পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী কাতারের মসজিদসমূহে পাঁচ ওয়াক্ত আজানের সময় আজানের সুরের মূর্ছনা এদের বিমোহিত করতো এবং তারা আজান শুনার জন্য মসজিদের আশপাশে ভীড় জমাতো। অনেকে এ সময় ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলেও শোনা যায়।

চট্টগ্রামের কথিত শিল্পপতি দম্পতি কোন ধাতুতে তৈরি আমি জানি না। বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বাইতুল মুকাররম তৈরির ইতিহাস যারা জানেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, দেশের এই বৃহত্তম মসজিদটি উর্দুভাষী একজন শিল্পপতি তৈরি করেছিলেন। তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের একজন শ্রেষ্ঠ ধনী ছিলেন। এই মসজিদের মিনার থেকে যখন আজান দেয়া হয় তার চার পাশের কয়েক মাইল রেডিয়াসের মধ্যে এর প্রতিধ্বনিও হয়। মক্কা মদীনা বায়তুল মোকাদ্দাস ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য মুসলিম দেশের মসজিদসমূহের আজানের ব্যঞ্জনার কথা এখানে নাইবা বললাম। এই আজানে কোনও মুসলমান বিরক্ত হন না বরং শোনার জন্য উদগ্রীব থাকেন।

আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের একটা অন্তিম নসিয়ত ছিল “মসজিদের ওই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই” তার কবিতায় প্রতিটি মসুলমানের আকাঙ্খাই প্রতিফলিত হয়েছে। চট্টগ্রামের শিল্পপতি দম্পতির হেদায়াতের জন্য আসুন আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া চাই।

https://dailysangram.com/post/512528