২ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ১০:৫০

ধরপাকড় মামলা সংঘর্ষে নিহতের ঘটনা ছিল আলোচনায়


সদ্য বিদায়ী বছরে (২০২২ সাল) দেশজুড়ে আলোচনায় ছিল ধারপাকড়, সংঘর্ষ ও গুলীতে নিহতের ঘটনা। এসময় বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। বছরের শেষের দিকে অক্টোবরে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি কয়েকটি কর্মসূচি ঘোষণা করায় রাজনৈতিক মাঠ কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণার পর বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এসব সংঘর্ষে বিভিন্ন স্থানে বিএনপির অন্তত ৮ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন বলে দাবি দলটির। ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর নয়া পল্টনে বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সমাবেশের স্থান নির্ধারণকে কেন্দ্র করে ১০ ডিসেম্বরের আগে থেকেই পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের। একপর্যায় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। এর মধ্যে কয়েকজনকে দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়।

এসময় দেশজুড়ে পুলিশের বিশেষ অভিযানে অন্তত ২৪ হাজার জনকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানায় পুলিশ সদর দফতর। বিএনপির দাবি গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই তাদের নেতা-কর্মী ও সমর্থক। সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর পঞ্চগড়ে বিএনপির গণমিছিল কেন্দ্র করে পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার সময় আবদুর রশিদ আরেফিন (৫০) নামের বিএনপির এক নেতা নিহত হন। তিনি বোদা উপজেলার ময়দানদিঘী ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন বলে জানিয়েছে দলটি। এ ছাড়া সংঘর্ষে পুলিশসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১০ জনকে আটক করেছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও গ্রেফতার করা হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানকে। ২৫ ডিসেম্বর তিন দিনের রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. আবুল বাসার। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এর আগে গত ১৩ ডিসেম্বর আদালত তার সাত দিনের ও ২১ ডিসেম্বর তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এছাড়াও গত ৯ নভেম্বর সিলেট থেকে গ্রেফতার করা হয় ডা. শফিকুর রহমানের ছেলে ডা. রাফাত সাদিককে। গ্রেফতার করা হয়, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম নয়ন প্রমুখ। সর্বশেষ গ্রেফতার করা হয়, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলমকে। ২৬ ডিসেম্বর রাতে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাকে গ্রেফতার করে। রাত ১১টার দিকে কলাবাগান এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পরপর তাকে প্রথমে ডিবি কার্যালয় ও পরে নিউমার্কেট থানায় হস্তান্তর করা হয়। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা বর্তমানে কারাবন্দী।

এছাড়াও পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী সারাদেশে প্রায় ২৪ হাজার জনকে গ্রেফতার করা হয় মাত্র ১৫ দিনে। পুলিশ সদরদফতরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সারা দেশে পুলিশের ১৫ দিনের বিশেষ অভিযানে ২৩ হাজার ৯৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ৩০ নভেম্বর শুরু হওয়া পুলিশের এ বিশেষ অভিযান ১৫ ডিসেম্বর শেষ হয়। দেশব্যাপী ৩৩ হাজার ৪২৯টি অভিযান চালিয়ে এসব ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশের দাবি-গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে তালিকাভুক্ত জঙ্গী ও সন্ত্রাসী ৭২ জন। বিজয় দিবস, বড়দিন, খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণ উদযাপন নিরাপদ ও নির্বিঘœ করতে এবং ঢাকায় আদালতফটক থেকে দুই জঙ্গীকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ বিশেষ অভিযান চালায় পুলিশ।

তবে বিএনপির অভিযোগ, তাদের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করতেই এ বিশেষ অভিযান। এর অংশ হিসেবে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীর প্রবেশপথগুলোয় তল্লাশিচৌকি বসানো হয়েছিল, যা সমাবেশের পর তুলে নেয়া হয়। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে বিভিন্ন মামলায় পরোয়ানাভুক্ত ১৫ হাজার ৯৬৮ জন আসামী। আর অভিযান চলাকালে ৫ হাজার ১৩২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৮ হাজার জনকে। এরই মধ্যে বিএনপির বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার শুরু করে পুলিশ। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বর নয়া পল্টনে বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে গ্রেফতার হন দলটির মহাসচিবসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।

জানা গেছে, গত ৭ ডিসেম্বর বিকেলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে একজন গুলীবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আহত হন অনেকে। এসময় বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে চাল-ডাল, পানি, নগদ টাকা ও বিস্ফোরকদ্রব্য পাওয়া যায় বলে দাবি করে পুলিশ। সংঘর্ষের ঘটনায় ৪৭৩ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় দেড় থেকে দুই হাজার বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামী করে মামলা করা হয়। রাজধানীর পল্টন মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে এ মামলা করে। মামলার উল্লেখযোগ্য আসামীদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপি জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপাসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল প্রমুখ। এদের মধ্যে আমান উল্লাহ আমান ও আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল জামিনে রয়েছেন। এরআগে পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা ও উসকানি দেয়ার অভিযোগে পল্টন থানায় করা মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালামসহ ৩৮ নেতাকর্মীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন আদালত। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন শুনানি শেষে তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর মৌচাক-মালিবাগে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে চারটি মামলা করে। পৃথক থানায় এসব মামলা দায়ের করা হয়। শনিবার দুপুরে মতিঝিল জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, মৌচাক-মালিবাগ এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় এসব মামলা করা হয়। মামলায় পুলিশের কর্তব্যে বাধা, হামলা ও বিস্ফোরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ তদন্তপূর্বক হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনবে। খিলগাঁও থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. ফারুকুল আলম বলেন, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় এসআই রেজাউল ইসলাম বাদী হয়ে এই থানায় দুটি মামলা করেছেন। মামলায় ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও অনেককে আসামী করা হয়েছে।

https://dailysangram.com/post/512494