২ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ১০:৪৫

শীতে কাঁপছে দেশ

ঠাণ্ডাজনিত রোগে বাড়ছে মৃত্যু

 শীতের তীব্রতা বাড়ছে দেশজুড়ে। মৃদু শৈত্যপ্রবাহ চলছে দেশের কয়েকটি জেলায়। শীতের কারণে ঠা-াজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় দেশের অধিকাংশ স্থানের জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। জীবন-জীবিকা নিয়ে সংশয়ে খেটেখাওয়া মানুষ। কোনো কোনো জেলায় দুপুর পর্যন্ত কুয়াশা কাটে না। কুয়াশার কারণে বেশ কয়েকটি মহাসড়কে যানজটের ঘটনা ঘটে। কোথাও কোথাও ফেরি পারাপারে ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগছে। একাধিক বিমান বন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বিঘিœত হয়েছে। শীত পড়েছে রাজধানী ঢাকাতেও। ঠা-ার কারণে মানুষকে শীতের মোটা পোশাক পড়ে বাসা থেকে বের হতে হচ্ছে। জরুরি কাজ না থাকলে বাসা থেকে বের হচ্ছে না মানুষ। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল ছিল পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া ও শ্রীমঙ্গলে। একদিন আগে তেঁতুলিয়ায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে আবার দুদিন পর রাতের তাপমাত্রা ফের কমতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। এখন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠলেও ঢাকাসহ সারাদেশেই শীতের তীব্রতা রয়েছে। বেলা অনেকটা গড়ালেও দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে ঘন কুয়াশার কারণে দেখা মেলে না সূর্যের। গতকাল রোববার সকালে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা নীলফামারীর ডিমলায় ৯ দশমিক ৮ থেকে ১১ দশমিক ৬, শ্রীমঙ্গলে ৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি থেকে বেড়ে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছে। ঢাকায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১৩ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে হয়েছে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বলে। আর তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে বলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। সারাদেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা ¬প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী তিনদিনের মধ্যে রাতের তাপমাত্রা কমতে পারে।জানা গেছে, গত দুদিনে রংপুর বিভাগে নিউমোনিয়ায় ২৯ জন ও ডায়রিয়ায় ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। কর্মকর্তারা এ কথা জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ডা. মো. হাবিবুর রহমান জানান, গত দুদিনে নিউমোনিয়ায় ২৯জন ও ডায়রিয়ায় ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। রংপুর, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি, গাইবান্ধা ও পঞ্চগড় জেলায় এসব মৃত্যু রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া শনিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪২৭ জন ঠাণ্ডজনিত রোগের কারণে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
লালমিনরহাটের সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার হাসপাতালগুলোতে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, এলার্জি ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে বেশিরভাগ রোগী হাসপাতালে আসছেন। পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম উত্তরাঞ্চলে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে সচ্ছল ও বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। নবেম্বরের মাঝামাঝি থেকে এ পর্যন্ত শীতের প্রকোপে পঞ্চগড় জেলায় ৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি জানান।
রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নবেম্বরের মাঝামাঝি থেকে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির কাছাকাছি নেমে এসেছে। শীতার্তদের মাঝে বিতরণের জন্য তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে ১০ লাখ কম্বল চেয়ে অনুরোধ পাঠিয়েছেন। রংপুর বিভাগে ৪ লাখ ২৬ হাজার কম্বল বরাদ্দ হয়েছে। এরমধ্যে ৩ লাখ ১২ হাজার পিস কম্বল বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে। মানিকগঞ্জ থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, ঘন কুয়াশার কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজরিহাট ফেরি চলাচল প্রায় ১১ ঘণ্টা বিলম্বিত হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসি সূত্র জানিয়েছে, পদ্মা নদীতে দৃশ্যমানতা বিপজ্জনকভাবে কমে যাওয়ায় ছয়টি ফেরি সকাল পৌনে ১১টা পর্যন্ত মাঝ নদীতে নোঙর করতে বাধ্য হয়েছে। এ সময় ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচলও বন্ধ ছিল।
দিনাজপুর অফিস: ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলের জনপথ। সড়ক-মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহন হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরগতিতে চলাচল করছে। এমনকি ট্রেনও দিনের বেলা লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে। কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। রাস্তায় মানুষের চলাচল একবারেই সীমিত। নিতান্তই প্রয়োজন কিংবা জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা মানুষের দেখা মিলছে পথে-ঘাটে। ছিন্নমূল আর গ্রামীণ মানুষ খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নি¤œ আয়ের খেটেখাওয়া মানুষজন।
দিনাজপুর আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, গতকাল রোববার দিনাজপুরে সকাল ৬টায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বাতাসের আর্দ্রতা ৯৬ শতাংশ। জেলায় চলতি শীত মৌসুমে সর্বনি¤œ ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে জেলায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হতে পারে। বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কমতে শুরু করবে। এ ছাড়া ৬ জানুয়ারির পর এই জেলার ওপর দিয়ে দুটি মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ।
দিনাজপুর শহরসহ মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলোতে সব ধরনের যানবাহনকে সকাল ১০ টা পর্যন্ত হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। ঢাকা থেকে দিনাজপুর গামী নৈশকোচগুলো ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা দেরিতে দিনাজপুরে পৌঁছেছে। ঢাকা গাজীপুর থেকে দিনাজপুরে আসা নাবিল কোচের যাত্রী হুমায়ুন পারভেজ বলেন, রাত ১১টায় উঠেছি। অন্যান্য দিন সকাল ৬টায় কালিতলা কোচ কাউন্টারে এসে পৌঁছে যায়। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে গাড়ি ধীরে চলেছে তাই ৪ ঘণ্টা দেরি হয়েছে। সকাল ১০টার সময় পৌঁছেছি। ‘মানুষ বিক্রির হাট’ নামে পরিচিত শহরের ষষ্ঠীতলা মোড়ে কাজের সন্ধ্যানে আসা নির্মাণ শ্রমিক আবুল হোসেন জানান, তিনি বিরল উপজেলা থেকে কাজের জন্য সকাল ৭টার সময় এখানে এসেছেন। কিন্তু সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কাজ পাননি। তিনি বলেন, এখনও নাস্তা করিনি। আজ আর কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফিরে যেতে হবে। শীতের কারণে প্রায় দিন তাকে কাজ না পেয়ে ফিরতে হয়। কুয়াশার কারণে ঢাকা থেকে আসা সংবাদপত্রের গাড়িগুলোও দেরিতে আসছে। শহরের এক মাত্র মহিলা পত্রিকা বিক্রেতা মরিয়ম বেগম বলেন, আমি পায়ে হেটে ফেরি করে পত্রিকা বিক্রি করি। পত্রিকার গাড়িগুলো দেরিতে আসায় কেউ পেপার নিতে চান না। দুপুরের পর পত্রিকাগুলো আসায় বেশি মানুষের কাছে যেতে পারি না। ফলে পত্রিকা কম বিক্রি হয়। আবার অনেকে দুপুরের পর পেপার নেন না। এতে আমার আয় তিন ভাগের এক ভাগে নেমেছে। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। একইভাবে ফেরি করে হাতের পায়ের মুজা, উলের টুপি, মাফলারসহ বিভিন্ন হুশিয়ারি শীতবস্ত্র বিক্রেতা আলিফ উদ্দিন, আব্দুর রহিম, শাহীন হোসেন, শাহরিয়ার মুকুল জানান, দেশের সবচেয়ে বড় হুঁশিয়ারি পণ্য তৈরির এলাকা গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাহার, নয়ারহাট ও পুরাতন বাজার থেকে তারা দিনাজপুরে এসেছেন হুঁশিয়ারি পণ্য বিক্রির জন্য। তারা বলেন, দিনাজপুরে শীত বেশি হওয়ায় তারা ৫০ জনের একটি দল এসেছেন। বেচাকেনাও বেশ ভালো। শীত যেভাবে বাড়ছে তাতে বেচাকেনা আরও বাড়বে।
জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার বড় গ্রামের ইট ভাটার শ্রমিক রহিম সরকার বলেন, দুই দিন ধরি ভাটায় যাইনি। পানির মতো শীত পড়ছে, আর ঘন কুয়াশা বাতাসের কারণে বাসায় বসে আছি। কজে গেলে ঠান্ডায় হাত-পা কোকড়া নাগি যাছে। অটো চালক সুজন ইসলাম বলেন, ঘনকুয়াশা আর ঠান্ডা বাতাসে মানুষ ঘর থেকে বাইরে বের হচ্ছে না। সকাল সাতটা পার হয়ে গেল এখনও একটা ভাড়া পাইনি। আগে দিনে সাত থেকে আটশ টাকা আয় হতো অটো চালিয়ে। এখন চার থেকে পাঁচশ টাকা আয় হয় না। খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে, একদিকে আয় কম অন্যদিকে বাজারের সব জিনিসের দাম বেশি।
মৌলভীবাজার সংবাদাতা : মৌলভীবাজারে গত কয়েক দিন থেকে টানা শীত কনকনে হিমেল হাওয়া ও কুয়াশার কারণে জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে।
রোববার ১ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সকাল ৯ টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আকাশ ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন রয়েছে। কয়েকদিন থেকে দুপুরের আগে সূর্যের দেখা মেলেনা। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেই ঘর থেকে বাইর হচ্ছেন না। ঘন কুয়াশার কারণে যানবাহন গুলো চলাচল করছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। দিনে ও রাতে খড়খুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছেন নি¤œ আয়ের মানুষজন। বিকেল হলে শীতের তীব্রতা বেড়ে সকাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকছে। শীতের কারণে সবচেয়ে বেশী হাওড়পাড় ও চা বাগান এলাকাসহ শ্রমজীবি মানুষ ভোগান্তিতে পরেছেন।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলস্থ আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, রোববার সকাল ৯টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন শনিবার তাপমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঘন কুয়াশা কমে গেলে তাপমাত্রা আরও কমতে থাকবে।
শীতজনিত রোগে প্রতিদিন মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে শিশু ও বয়স্কদের নিয়মিত ভর্তি অব্যাহত রয়েছে। গরম কাপড়ের দোকানে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ভিড় প্রতিদিন বাড়ছে।

https://dailysangram.com/post/512489